পারমানবিক শক্তিধর দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে হিমালয়ের কোল ঘেঁষে থাকা প্রকৃতি কন্যা কাশ্মির নিয়ে দু’দেশের মধ্যে চলা দীর্ঘদিনের বিবাদ মেটাতে এ বছর জানুয়ারিতে দুবাইয়ে গোপন বৈঠক হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবর।
এই দুই দেশের মধ্যে শান্তি আলোচনায় পানি ঢেলে দেয় সর্বশেষ বালাকোট হামলা। ২০১৯ সালে ভারতের সেনাবহরে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা পর থেকে পরিস্থিতি ক্রমেই দুই দেশের মধ্যে খারাপ হতে থাকে। সম্পর্ক তলানিতে ঠেকতে শুরু করে ইমরানের দেশ ও মোদীর ভারতের মধ্যে। দুই নিউক্লিয়ার শক্তিধর দেশের মধ্যে আরও সংঘাতের পারদ চড়তে শুরু করে কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা আবলুপ্তির পর থেকে। অনুসন্ধান রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এই হামলার পেছনে পাকিস্তানের হাত আছে। এরপর ভারতও পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালায়।
ওই বছর পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাশ্মিরে স্বায়ত্তশাসনের আইন রদ করে, মুসলিম অধ্যুষিত ওই এলাকায় নিজের দখলদারিত্ব জোরদার করে। কাশ্মিরের মানুষের উপর শুরু হয় নির্যাতন, ধড়-পাকড়, লুটপাট। কারফিউ জারি করা হয় অঞ্চলটিতে। বিচ্ছিন্ন ছিল ইন্টারনেট সংযোগ থেকে। বহির্বিশ্বের চোখের আড়ালে নিয়ে যাওয়া হয় কাশ্মিরকে। গুম হয় অনেক মানুষ। গ্রেফতার হয় কাশ্মিরের সব নেতাকর্মীরা। পাকিস্তানের সাথে সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও বাতিল করা হয়।
রয়টার্সের সূত্র মতে, এর পরের কয়েক মাস থেকেই দুই দেশ যোগাযোগের একটি মাধ্যম তৈরি করতে চেয়েছে। কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন চেয়েছে। যাতে দুইদেশের মধ্যকার যুদ্ধপরিস্থিতিকে এড়ানো যায়।
কাশ্মির দীর্ঘদিন ধরেই ভারত ও পাকিস্তানের মাথা ব্যথার কারণ। দুই দেশই সমগ্র কাশ্মির দাবি করে আসলেও শাসন করছে এর অংশবিশেষ।
সূত্র মতে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র) এবং পাকিস্তানের গোয়ন্দো সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) সংযুক্ত আরব আমিরাতের সহায়তায় এক বৈঠকে আলোচনার জন্য দুবাইয়ে সাক্ষাৎ করেন।
যদিও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ প্রসঙ্গে কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। এমনকি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, যারা আইএসআই নিয়ন্ত্রণ করে, তারাও কোন উত্তর দেয়নি।
কিন্তু পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন ভারত ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা কয়েক মাস ধরেই অন্যান্য দেশের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করে আসছে।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি থাইল্যান্ড, দুবাই এবং লন্ডনে এই দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সর্বোচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক হয়েছে।’
অতীতেও এমন অনেক বৈঠকে দুই দেশ অংশগ্রহণ করেছে। বিশেষ করে দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধপরিস্থিতির অবনতিতে। তবে কখনও তা সামনে আনা হয়নি।
নয়াদিল্লি থেকে নাম প্রকাশ না করে দু’জন কর্মকর্তা এ বিষয়ে কথা বলেন। তাদের মধ্যে একজন বলেন, এখনও এমন অনেক কিছু আছে যার জন্য এই বৈঠক অসফল হতে পারে। বিশ্বাসঘাতকতাও হতে পারে।
অন্যজন বলেন, এইজন্য এই বৈঠকের প্রসঙ্গ কোন দেশই সামনে আনছে না। এই বৈঠকের কোন নাম নেই। এটা শান্তি প্রক্রিয়া নয়। আপনার এটাকে পুনরায় চুক্তিতে আসার উপায় বলতে পারেন।
দুই দেশেরই কারণ আছে, বিবার মিটিয়ে পুনরায় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে আসার।
গত বছর ধরে ভারতের চীনের সাথে সীমান্তে যুদ্ধপরিস্থিতি বিরাজ করছে। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতিও হয়েছে। তো ভারত পাকিস্তান সীমান্তেও একই অবস্থা চাইবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের মিত্র পাকিস্তান অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। পাকিস্তানের অর্থনীতিকে দাঁড় করাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) রেসকিউ প্রোগ্রাম চলছে। তাদের জন্য কাশ্মীর সীমান্তে ভারতের সাথে বিবাদের দীর্ঘসূত্রতা বিপদ ডেকে আনবে। পাশাপাশি পাকিস্তানের পশ্চিমে আফগান সীমান্তেও স্থিতিশীলতা আনতে হবে।
রয়টার্সের সাবেক সাংবাদিক মায়রা ম্যাকডোনাল্ড কাশ্মির সীমান্তে ভারত, পাকিস্তান এবং যুদ্ধের উপর সম্প্রতি একটি বই প্রকাশ করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে জানান, ভারত ও পাকিস্তানের জন্য কথা না বলার থেকে কথা বলা অনেক ভালো। এবং তারা যদি বিশ্বের চোখ এড়িয়ে নিজেদের বিবাদ মেটাতে পারে, সেটা তাদের জন্য আরও ভালো।
তবে এটা ঝুটঝামেলা ছাড়া খুব বেশি দূর গড়াবে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে দুই দেশই যখন কঠিন পরিস্থির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘটনায় পাকিস্তানকে আফগান সীমান্ত নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। এদিকে ভারতের তার থেকেও সীমান্তে বড় সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে চীনের সাথে।
জানুয়ারিতে হওয়া বৈঠকে ভারত-পাকিস্তান লাইন অব কন্ট্রোলে (এলওসি) গোলাগুলি বন্ধের ঘোষণা দেয়। এই গোলাগুলিতে দুই দেশেরই বহু সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে। অনেকে হয়েছে পঙ্গু। তবে আশার কথা দুই দেশেই অস্ত্রবিরতির সিদ্ধান্তে এখনও অটল আছে।
পাশাপাশি দুই দেশ নিজ নিজ অঞ্চলে এ বছরই নির্বাচনের পূর্বাভাস দিয়েছেন, কাশ্মিরে কয়েক দশকের রক্তাক্ত পরিস্থিতি থেকে জীবনযাত্রায় স্বাভাবিকতা আনতে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের মুখপাত্র জানান, দুই দেশ একে অন্যের প্রতি মন্তব্য প্রকাশেও সচেতন থাকবে বলে জানিয়েছে।
এর মধ্যে থাকবে ২০১৯ সালের আগস্টে মোদির কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিলের সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের জোরালো প্রতিবাদ। অন্যদিকে নয়াদিল্লি লাইন অব কন্ট্রোলে পাকিস্তানের সহিংসতার অভিযোগের মুখে লাগাম দেবে।
এমন আগে কখনও হয়নি। ভারত-শাসিত কাশ্মিরে পাকিস্তানের নাক গলানো নিয়ে নয়াদিল্লি দীর্ঘকাল দোষারোপ করে এসেছে ইসলামাবাদকে। যা সবসময়ই অস্বীকার করে এসেছে পাকিস্তান।
যদিও ৭৪ বছর ধরে চলমান কাশ্মির বিবাদ মেটানোর কোনও ইচ্ছা দুই দেশের নেই। শুধুমাত্র নিজ নিজ স্বার্থের কথা বিবেচনা করে এই দুই দেশ নিজেদের মধ্যকার বিবাদ কিছুটা ধামাচাপ দিতে চাইছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিশেষ সহযোগী রাউফ হাসান রয়টার্সকে বলেন পাকিস্তান বর্তমানে জিওস্ট্রাটেজিক অঞ্চল থেকে জিও-ইকোনমিক অঞ্চলে পরিবর্তিত হচ্ছে। এ পরস্থিতিতে দেশের অভ্যন্তরে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৩৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ