হত্যা, নিপীড়ন আর লুটপাটে মিয়ানমার যেন দ্বিতীয় সিরিয়া। প্রায় আড়াই মাস রাজপথে আন্দোলন চললেও বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের আলোচনায় বসার আগ্রহ দেখায়নি জান্তা সরকার। বরং বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে জান্তা সরকার। স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স’-এর (এএপিপি) হিসাব অনুযায়ী, গত আড়াই মাসে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে সাত শতাধিক বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে। গ্রেপ্তার কিংবা গুম করা হয়েছে অন্তত তিন হাজার ব্যক্তিকে। বিক্ষোভ দমাতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট সংযোগও। অনেক জায়গায় জারি করা হয়েছে সামরিক আইন।
অভ্যুত্থানের পরেই নিজ নিজ জায়গা থেকে জান্তার বিরুদ্ধে সরব হয় দেশটির সাধারণ মানুষ। জান্তাকে বেকায়দায় ফেলতে ‘অসহযোগ’ আন্দোলনের ডাক দেয় তারা। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে লাখ লাখ সরকারি চাকরিজীবী কর্মবিরতি শুরু করেন। ফলে দেশটির সেবামূলক সব খাত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই আন্দোলনে আছেন চিকিৎসক, ব্যাংককর্মী, প্রকৌশলী, শুল্ক কর্মকর্তা ও রেলের কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার কয়েক লাখ মানুষ। আন্দোলনে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা বলছেন, তারা কাজে যোগ না দিলে জান্তা সরকার একসময় কোণঠাসা হয়ে পড়বে।
অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে মিয়ানমারের অন্তত দুই ডজন আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালিয়ে আসছে। এদের মধ্যে কয়েকটি সংগঠন গত ৩০ মার্চ জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার হুমকি দেয়। এরই মধ্যে এসব সংগঠনের হামলায় ১৪ পুলিশ ও ১২ সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব সংগঠন আন্দোলনে সম্পৃক্ত হলে মিয়ানমারে অবধারিতভাবে গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে।
জাতিসংঘের সতর্কবার্তা
মিয়ানমারের পরিস্থিতি পুরোপুরিভাবে সংঘাতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছে জাতিসংঘ। বুধবার এক বিবৃতিতে সংস্থাটির মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিশেল ব্যাচলেট এই সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেন। মিয়ানমারে যেন সিরিয়ার পুনরাবৃত্তি না ঘটে; সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সজাগ থাকার আহ্বান জানান তিনি।
মিশেল ব্যাচলেট বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সিরিয়া এবং বিশ্বের অন্যত্র ঘটে যাওয়া অতীতের মারাত্মক ভুলের পুনরাবৃত্তি মিয়ানমারে করতে দেওয়া উচিত হবে না।
তিনি বলেন, ২০১১ সালে সিরিয়ার যে পরিস্থিতি ছিল অভ্যুত্থান পরবর্তী মিয়ানমারে তার স্পষ্ট প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
মিশেল ব্যাচলেট বলেন, মিয়ানমারেও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর বলপ্রয়োগ করা হচ্ছে। নিজ দেশের নাগরিকদের ওপর রাষ্ট্রের অব্যাহত নৃশংস নিপীড়ন কিছু ব্যক্তিকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে প্ররোচিত করছে। পরবর্তীতে সারা দেশে দ্রুত সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে।
মিয়ানমার সেনাদের ‘লাশ ব্যবসা’
এদিকে মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত বিক্ষোভকারীদের লাশ হস্তান্তরের জন্য ভুক্তভোগী পরিবারের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায় করছে সেনাবাহিনী। লাশ নিতে সেনাবাহিনীকে অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে নিহতদের স্বজনদের। গত শুক্রবার নিরাপত্তা বাহিনীর তাণ্ডবে নিহতদের মরদেহের জন্য জনপ্রতি ৮৫ ডলার করে নিচ্ছে তারা।
জান্তাবিরোধী বিক্ষোভকারীদের গড়ে তোলা ব্যারিকেড অপসারণ করতে গিয়ে শুক্রবার মধ্যাঞ্চলীয় শহর বাগোতে ব্যাপক তাণ্ডব চালায় বর্মি বাহিনী। এদিন অন্তত ৮২ বিক্ষোভকারীকে হত্যা করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। তাদের মরদেহ নিতে এখন অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে স্বজনদের।
বাগো ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন-এর এক ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে, শুক্রবার নিহতদের মরদেহের জন্য নিহতদের স্বজনদের কাছ থেকে এক লাখ ২০ হাজার কিয়াত (৮৫ ডলার) করে নিচ্ছে সেনাবাহিনী। একই রকমের খবর দিয়েছে সংবাদমাধ্যম রেডিও ফ্রি এশিয়ার বার্মিজ সার্ভিস।
মৃত্যুপুরী মিয়ানমার
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের পর মঙ্গলবার পর্যন্ত সরকারি বাহিনীর হাতে কয়েক ডজন শিশুসহ ৭১৪ জন নিহত হয়েছে। আটক করে রাখা হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে।
তবে জান্তা সরকারের মুখপাত্র মেজর জেনারেল জাও মিন তুন এ সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, তারা ২৪৮ বেসামরিক এবং ১০ পুলিশ সদস্য নিহতের ঘটনা রেকর্ড করেছে।
শুক্রবারের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছেন বিক্ষোভকারীদের একজন সংগঠক ইয়ে হিট। জাতিসংঘ জানিয়েছে, বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার এবং আহতদের চিকিৎসা না দেওয়ার বিষয়ে নজর রাখছে।
গত ১ ফেব্রুয়ারির সেনা অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করতে বাগো শহরের রাস্তায় ব্যারিকেড গড়ে তোলা হয়। প্রায় আড়াই লাখ মানুষের শহরটিতে শুক্রবার সন্ধ্যা নামার আগেই অভিযান শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাগো শহরের এক বাসিন্দা বলেন, আমাদের মানুষেরা বুঝতে পেরেছিলো তারা (নিরাপত্তা বাহিনী) আসতে পারে। আর এজন্য রাতভর অপেক্ষা ছিলো। সেনাসদস্যরা ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেছে। আমরা মর্টার শেলও পেয়েছি। মেশিনগান দিয়েও প্রচুর গুলি করা হয়েছে। তাজা গুলি ছাড়াও সেনাসদস্যরা গ্রেনেড লাঞ্চার ব্যবহার করেছে।
এখন সেদিনের ঘটনায় নিহতদের লাশ হস্তান্তরের জন্যও স্বজনদের কাছে অর্থ দাবির খবর আসছে। এমন পরিস্থিতিতেই বুধবার মিয়ানমারে যেন সিরিয়ার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার।
১৯ বিক্ষোভকারীর মৃত্যুদণ্ড
সামরিক বাহিনীর এক সহযোগীকে হত্যার অভিযোগ এনে মিয়ানমারের ১৯ জন অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার (৯ এপ্রিল) সামরিক বাহিনীর মালিকানাধীন মিয়াওয়াড্ডি টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে ইয়াঙ্গুনের একটি জেলায় ওই সহযোগীকে খুন করা হয়।
টানা বিক্ষোভের মধ্যে ২৭ মার্চ ইয়াঙ্গুনের উত্তর ওক্কালাপা জেলায় সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনকে মারধর এবং তার এক সহযোগীর মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় বিক্ষোভকারীদের দায়ী করে সেনা সরকার।
ঘটনার পরই ওই জেলায় সামরিক আইন জারি করে সামরিক আদালত পরিচালনার পথ উন্মুক্ত করা হয়। শুক্রবার সেই আদালতেই ১৯ বেসামরিক বিক্ষোভকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১৭ জনকেই তাদের অনুপস্থিতিতে দণ্ড দেওয়া হয়। অভ্যুত্থানের পর এটাই প্রথম কোনও প্রকাশ্য দণ্ড ঘোষণা করলো সেনা সরকার।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫৩৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ