মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলে লাশের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশটির ক্ষমতা দখলের পর বিক্ষোভকারীদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভকারীদের ধরতে গতকাল শুক্রবার রাতভর অভিযান চালানোর সময় সেনাদের নির্বিচার গুলিতে মারা গেছে অন্তত ৬০ জন। মৃতদের লাশ ছিনিয়ে নিয়ে গেছে সেনারা। বিক্ষোভ দমনে মিয়ানমার সেনারা মেশিনগান, গ্রেনেড এবং মর্টার ব্যবহার করছে। বিবিসি
মার্কিন সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত সংবাদমাধ্যম রেডিও ফ্রি এশিয়ার (আরএফএ) এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, শুক্রবার মিয়ানমারের বাগো শহরে গুলিবৃষ্টি চালিয়েছে পুলিশ ও সেনাবাহিনী। রাজপথে বিক্ষোভকারীদের ব্যারিকেডও তুলে নিয়েছে তারা।
এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, আমাদের এলাকার লোকজন জানত ওরা আসবে এবং এর জন্য রাতভর অপেক্ষা করছিল।
তিনি বলেন, সেনারা ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এমনকি আমরা মর্টার শেলও পেয়েছি। মেশিরগান থেকে প্রচুর গুলি করা হয়েছে। তাজা গুলির পাশাপাশি সেনারা গ্রেনেড লঞ্চার ব্যবহার করছিল বলা হচ্ছে।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি, রাস্তা ফাঁকা করতে সাধারণ পথচারীদের দিকেও গুলি করেছে সেনারা।
নিরাপত্তা বাহিনী প্রায় গোটা রাত এভাবে তাণ্ডব চালানোয় হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আরেকজন স্থানীয় বাসিন্দা রেডিও ফ্রি এশিয়াকে জানান, তারা রাত ৮টা পর্যন্ত মাত্র তিনটি মরদেহ সংগ্রহ করতে পেরেছেন। বাকিগুলো সেনারা নিয়ে গিয়ে জেয়ামুনি প্যাগোডা এবং কাছাকাছি একটি স্কুলে জড়ো করেছে।
মিয়ানমারে সরকারবিরোধীদের ওপর প্রতিনিয়ত সরাসরি গুলি চালানোর নতুন নুতন ভিডিও প্রকাশ পাচ্ছে। এতে দেখা যায়, কয়েকটি বসতবাড়ি ঘোরাও করে সেখানে থাকা সাধারণ মানুষের ওপর সরাসরি গুলি ছুড়ছে দেশটির সামরিক বাহিনী।
শুধু বিক্ষোভে দমন-পীড়ন চালিয়েও ক্ষান্ত হচ্ছে না মিয়ানামারের সামরিক সরকার। এবার ইন্টারনেট সেবা সীমিত করার পাশাপাশি স্যাটেলাইট টিভি দেখাও নিয়ন্ত্রণ করার পদক্ষেপ নিয়েছে সামরিক জান্তারা। এ জন্য বেশকিছু এলাকায় স্যাটেলাইট ডিস এন্টেনা জব্দ করেছে তারা।
তবে সেনাবাহিনীর অব্যাহত দমন-পীড়নের পরও বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন দেশটির আন্দোলনকারীরা। অন্যান্য দিনের মতো গতকাল শুক্রবারও বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ করেন তারা। এতে হামলা চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। হতাহত হন বেশ কয়েকজন।
এদিকে সেনাবাহিনীর এক ক্যাপ্টেনের সহযোগীকে হত্যার অপরাধে ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক আদালত।
শুক্রবার দেশটির সামরিক বাহিনীর মালিকানাধীন মায়াবতী টেলিভিশন এ খবর দিয়েছে বলে সংবাদ নিশ্চিত করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াংগুনের নর্থ ওক্কালাপা জেলায় সেনাবাহিনীর ওই ক্যাপ্টেনের সহযোগীকে খুন করা হয়। সেই ঘটনায় ১৯জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার সময় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৭ জন উপস্থিত ছিলেন না।
তবে কবে ও কিভাবে সেনা কর্মকর্তার ওই সহযোগী খুন হয়েছিলেন তার বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি সেই প্রতিবেদনে।
এদিকে আগামী দুই বছরের মধ্যে মিয়ানমারে নির্বাচন অনুষ্ঠিতের কথা জানিয়েছে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার। শুক্রবার রাজধানী নেপিদোতে এক সংবাদ সম্মেলনে সামরিক সরকারের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জ মিন তুন এ কথা বলেন। খবর রয়টার্সের।
রয়টার্স জানায়, প্রথমবারের মতো দুই বছরের মধ্যে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মিয়ানমারের সেনা সরকার।
দেশটিতে গত নভেম্বরে নির্বাচনে জালিয়াতির দাবি করে গত ১ ফেব্রুয়ারি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। সেনাবিরোধী বিক্ষোভ জোরালো হওয়ার পর সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, এর আগে কোনো সময়সীমা জানানো হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে জেনারেল তুন দাবি করেন, তাদের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ক্ষীণ হয়ে এসেছে কারণ মানুষ শান্তি চায়।
তিনি বলেন, ‘বিক্ষোভ কমে আসার কারণ হলো শান্তি চায় এমন মানুষেরা সহযোগিতা করছেন। কারণ এটি মূল্যবান।’ তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা বাহিনীকে সহযোগিতা করতে আমরা জনগণের প্রতি অনুরোধ জানাই।’
এদিকে জান্তা সরকারের দমনপীড়ন ও সাধারণ মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় মিয়ানমারের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাশাপাশি দেশটিতে নো-ফ্লাই জোন ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত মিয়ানমারের দূত কিয়াও মোয়ে তুন। একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে সামরিক সরকারের ওপর আরও চাপ প্রয়োগ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।
গত বছরের নভেম্বরের নির্বাচনে দেশটির নেত্রী অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আবারও ক্ষমতায় আসে। সামরিক বাহিনী এই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুললেও নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানিয়ে দেয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এক বছরের জন্য দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করে। তখন থেকে প্রায় প্রত্যেকদিন মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী বিক্ষোভকারীরা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছেন। সামরিক জান্তা এ পর্যন্ত প্রায় ৭’শ বিক্ষোভকারীকে হত্যা করেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ