মহামারি করোনা ভাইরাস মানুষের জীবন যাত্রায় ব্যাপক বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। মানুষজন এখন করোনা সামলানোর চেয়ে করোনা কর্তৃক উদ্ভব পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। খাদ্য ও খাদ্য বর্হিভূত ব্যয় কমানো, সঞ্চয় ভেঙ্গে চলার মতো পদক্ষেপের পরও ৬১ শতাংশ পরিবার ঋণ নিয়ে করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে বাধ্য হচ্ছে। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ’র এক জরিপ এমন তথ্য উঠে এসেছে।
আজ বৃহস্পতিবার(৮ এপ্রিল) এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের ‘কীভাবে অতিমারিকে মোকাবিলা করছে বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী’ শীর্ষক একটি খানা জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে। এ উপলক্ষে ভার্চ্যুয়াল উপায়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
কোভিড সংকট মোকাবিলায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সহায়তার জন্য একটি সামাজিক সংহতি তহবিল গঠনের সুপারিশ করে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম। এতে তহবিলে সরকার, করপোরেট প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিপর্যায়ে অংশগ্রহণ করতে পারে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ১ হাজার ৬০০ খানার ওপর এই জরিপ করা হয়েছে। চর, হাওর, উপকূল, বস্তি, দলিত, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, প্রবাসফেরত, পিছিয়ে পড়া নারী এবং অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ওপর এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে জরিপের ফলাফলের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সংস্থার জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক ইশতিয়াক বারী।
জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, করোনা সংকটের সময় এই প্রান্তিক শ্রেণির ৮০ শতাংশ পরিবার খাবার কিনতে খরচ কমিয়েছে। আর ৬৪ শতাংশের বেশি খাদ্যবহির্ভূত খাতে খরচ কমাতে হয়েছে। আর প্রায় ৬১ শতাংশ পরিবার ঋণ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে বাধ্য হয়েছে। এ ছাড়া নিজের গবাদিপশু বিক্রি করে, এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে, সরকারি সহায়তা, সোনাদানা ও জমি বিক্রি করেও অনেকে জীবন ধারণ করছেন।
জরিপে উঠে এসেছে যে করোনার আঘাত সামলাতে প্রথমে সঞ্চয় ভেঙেছেন এসব প্রান্তিক মানুষ। এরপর ঋণ করেছেন। তারা ভোগও কমিয়েছেন। প্রথমে খাবারে, পরে গৃহস্থালির খরচ কমিয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিডের পর মানুষের আয় কমেছে ১৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। বিপরীতে ব্যয় কমেছে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। আর সঞ্চয় কমেছে ৬৪ দশমিক ৬০ শতাংশ।
যেসব পরিবার খাদ্য ব্যয় কমিয়েছে তাদের মধ্যে ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার খাদ্যতালিকা থেকে আমিষ জাতীয় খাবার বাদ দিয়েছে, ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ খাবার থেকে পদ কমিয়ে দিয়েছে, ৬ দশমিক ৮ শতাংশ কোনও এক বেলার খাবার বাদ দিয়েছে এবং ৯ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবারকে শিশুখাদ্যের খরচ কমাতে হয়েছে।
জরিপে বলা হয়, ২০ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবার অর্থের জন্য তাদের সঞ্চয় ভেঙেছে। গড়ে একটি পরিবার ৩৪ হাজার ৪৬২ টাকার সঞ্চয় উঠিয়েছে। ৪৭ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার ঋণ নিয়েছে এবং গড়ে প্রতি পরিবার ৫২ হাজার ৫৩৩ টাকা ঋণ নিয়েছে। তাদেরকে মূল ঋণের টাকা পরিশোধ করতে দুই বছর এক মাস সময় লাগবে বলে জরিপের ফলাফলে বেরিয়ে এসেছে।
জরিপে ৭০ শতাংশ পরিবারের সদস্য জানিয়েছেন, তারা কোভিড-১৯ টেস্টের প্রয়োজন অনুভব করেননি। ১২ দশমিক ৩ শতাংশ বলেছে আর্থিক অক্ষমতার কারণে তারা টেস্ট করাতে পারেননি।
আবার ২ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষকে চিকিৎসক পরামর্শ দিলেও তারা পরীক্ষা করাননি। এদের মধ্যে কোথায় যেতে হবে তা না জানা এবং সামাজিক নিপীড়নের ভয়ের কথাও উল্লেখ করেন তারা।
“তবে এসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে সরকার ফ্রি ভ্যাকসিন দিলে তা নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে ৮২ শতাংশ মানুষ,”জানান এই গবেষক।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, মহামারীকালে ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ সরকারি সহায়তা নিয়েছেন। ১১ দশমিক ৯ শতাংশ পারিবার, বন্ধু ও প্রতিবেশিদের থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন। বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন ২১ দশমিক ৯ শতাংশ। আবার বিভিন্ন দান বা অনুদান নিয়েছেন ৮ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ।
মহামারীর প্রথমদিকে প্রতি ৭০ জনে একজন চাকরি হারিয়েছেন। পরে আবার প্রতি ৯১ জনের মধ্যে একজন চাকরি পেয়েছেন বলে জরিপের আরেক উপাত্তে দেখা গেছে।
এই গবেষণার ওপর মূল্যায়ন করতে গিয়ে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহবায়ক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “অতিমারী চলাকালীন সময়ে প্রান্তিক মানুষের জন্য সরকারি সহায়তা যথেষ্ট নয়। এই সহযোগিতা আরও বহুগুণ বাড়ানো উচিত।”
তিনি বলেন, “এই অতিমারী সংকটাপন্ন মানুষকে আরও বিপন্ন করেছে। তাদের এই সমস্যা বহুমাত্রিক। এক দিকে তাদের আয় কমে গেছে, খাদ্য সংকটে পড়েছে, আবার ঋণ গ্রস্থ হচ্ছে।“
মহামারী মোকাবিলায় আগামী বাজেটে ‘সংহতি তহবিল’ গঠনের পরামর্শ দিয়ে ড. দেবপ্রিয় বলেন, এই তহবিল থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ নিশ্চিত করা গেলে প্রান্তিক মানুষের সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
অনুষ্ঠানে সিপিডির আরেক সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিকুজর রহমান সংহতি তহবিল গঠনকে যৌক্তিক পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করে এটি সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিদের সমন্বয়ে পরিচালনার কাঠামো গঠনের কথা বলেন। তিনি আগামী বাজেটে এ জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার পরামর্শ দেন।
এক প্রশ্নের জবাবে জরিপের প্রধান গবেষক ইশতিয়াক বলেন, জরিপকালে এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠী জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের সময়কার কষ্টের মধ্যে টিকে থাকতে প্রথমে খাদ্য বাছাইয়ে সামঞ্জস্য আনার অর্থ্যাৎ সুষম খাবার বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এরপর খাদ্য বহির্ভূত পণ্য কেনা বাদ দিয়েছেন। এরপরও ৬১ শতাংশ পরিবার বলেছেন তারা ঋণগ্রস্থ হচ্ছেন।
তিনি বলেন, “মহামারীর মধ্যে তারা চলমান আয় দিয়ে চলতে পারছেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে- উপকুলীয় এলাকার ৮৬ শতাংশ, বস্তিবাসীর ৮৭ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি (এমএসএমই) উদ্যোক্তাদের প্রায় ৯৩ শতাংশ মানুষ তাদের চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন”।
দেবপ্রিয় বলেন, প্রথাগতভাবে আমাদের দেশে যারা বিপন্ন মানুষ, এটা (কোভিড-১৯) তাদের জন্য আরও দুর্যোগ টেনে এনেছে। আবার যারা বিপন্ন ছিলেন না, তাদের অনেকে এই ধাক্কাতে অসহায়ত্বের পর্যায়ে চলে গেছেন। শুধু ছোট ছোট প্রণোদনা না, এটাকে ২-৩ বছরের জাতীয় সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নিতে হলে যে মানুষগুলো জনমানুষের কাছাকাছি থাকেন যেমন- স্থানীয় সরকার, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং স্থানীয় প্রশাসনকে আরও শক্তিশালীভাবে যুক্ত করতে হবে।
তিনি বলেন, মনুষ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার বিষয়ে বেশি সন্তুষ্টি রয়েছে। তারপর এসেছে স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধি ও জনপ্রতিনিধি। এরপর এসেছে প্রশাসন। সরকার হয় কোনো সচেতনতার অভাব আছে অথবা তারা সচেতনভাবে এটাকে অস্বীকার করার মনোভাবের ভেতরে আছে। এই অস্বীকারের মধ্যে থাকলে মানুষের দুঃখ-কষ্ট আরও দীর্ঘায়িত হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেক পরিবার ঋণের ফাঁদে পড়ে যেতে পারে। তাদের সুরক্ষা দিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২১
আপনার মতামত জানানঃ