বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য যেসব গ্যাস দায়ী সেগুলোর মধ্যে মিথেন অন্যতম। গ্রিনহাউজ গ্যাসের তালিকায় উপরের দিকেই রয়েছে এই গ্যাসটি। এতদিন খলনায়ক হিসাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে টেনে আনা হলেও এবার সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে মিথেন। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, দূষণ বৃদ্ধিতে সবার নজর এড়িয়ে নিজের কাজ করে যাচ্ছে মিথেন। আর এর উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয় বাংলাদেশে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। আর এখান থেকেই মিথেন গ্যাস প্রবল পরিমাণে নির্গত হয় বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের উপরে মিথেন গ্যাসের আস্তরণ শনাক্ত করেছে অন্তত তিনটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা। নিউইয়র্কভিত্তিক আর্থিক ও ডেটাসেবা প্রদানকারী এবং মিডিয়া কোম্পানি ব্লুমবার্গ তাদের একটি প্রতিবেদনে এই গ্যাসকে ‘রহস্যময়’ বলে উল্লেখ করেছে।
আজ বৃহস্পতিবার(৮ এপ্রিল) প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্রান্সের কোম্পানি কায়রোস এএএস চলতি বছর বাংলাদেশের উপরে ১২টি সর্বোচ্চ মিথেন নিঃসরণের হার শনাক্ত করেছে। কিন্তু কোথা থেকে মিথেন গ্যাস নি:সরণ হচ্ছে সেই ছিদ্রগুলি শনাক্ত করতে বিশেষ স্যাটেলাইট দিয়ে পর্যবেক্ষণ চালানো হচ্ছে।
জিএইচসিএসএটি নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট স্টিফেন জার্মেইন জানিয়েছেন, তারাও বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের ধোঁয়া শনাক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের দেখা সবচেয়ে শক্তিশালী টেকসই নির্গমন। এর উৎস সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না।’
ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ডেটা বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান ব্লুফিল্ড টেকনোলজিসও বাংলাদেশের উপরে এই গ্যাস শনাক্ত করেছে।
ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ডাটা পর্যালোচনা করে ব্লুফিল্ড টেকনোলজিস ইনকরপোরেশন। গত বছরের মে মাসে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার ওপরে বিপুল পরিমাণ মিথেনের মেঘ দেখতে পায়। পাশাপাশি তারা বাংলাদেশের ওপরে মিথেনের ঘনত্বটা শনাক্ত করে।
এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ইয়োতাম এরিয়েল বলেন, আমাদের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মিথেন নিঃসরণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ বিষয়টি স্যাটেলাইটেই শনাক্ত করা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি মিথেন গ্যাসের উৎস কোনটি তা চিহ্নিত করার কাজ সবেমাত্র শুরু করেছেন বিজ্ঞানীরা। মহাশূন্য থেকে এই পর্যবেক্ষণ হতে পারে মৌসুমী। অর্থাৎ মৌসুমভেদে এর পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। এর কারণ, মেঘের আচ্ছাদন, বৃষ্টিপাত এবং আলোর তীব্রতার ভিন্নতা। সমুদ্র থেকে নিঃসরিত গ্যাস শনাক্ত করা স্যাটেলাইটের জন্য কঠিন হতে পারে। এসব গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে আর্কটিকের মতো উচ্চতর অক্ষাংশে। আর্কটিকে রাশিয়ার রয়েছে তেল ও গ্যাস পরিচালনার বড় কর্মযজ্ঞ। এর ফলে সীমিত ডাটা পাওয়া যাচ্ছে, যার ওপর ভিত্তি করে বৈশ্বিক সার্বিক পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না।
কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যে মাত্রায় মিথেন গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে তা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এর কম উচ্চতা এবং জনসংখ্যার উচ্চ ঘনত্ব এই দেশটিকে চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বিপন্ন করে তুলেছে। ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের চেয়ার বর্তমানে বাংলাদেশ। এই ফোরামের ৪৮টি সদস্য দেশে রয়েছেন ১২০ কোটি মানুষ। তারা জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
বিজ্ঞানীরা এখন শুধু মিথেনের বড় উৎসটি খুঁজছে। মহাকাশ থেকে সেটার নজর রাখা কঠিনকারণ মেঘ, বৃষ্টিপাত ও আলোর ভিন্নতা। কিন্তু বাংলাদেশের উপর থেকে দেখা যাওয়া এই নির্গমন বেশ ভাবাচ্ছে সবাইকে। বাংলাদেশের কম উচ্চতা ও অধিক জনসংখ্যাই সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয়।
বাংলাদেশের পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের একটি সাক্ষাৎকারের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন।
তিনি বলেন, ‘এটি সম্ভবত ধানখেত থেকে আসছে। যখন কৃষকেরা তাদের খেত সেচের পর ভাসিয়ে দেন, তখন জলাবদ্ধ মাটির ব্যাকটেরিয়া বিপুল পরিমাণ গ্যাস তৈরি করতে পারে। আরেকটা উৎস হচ্ছে ল্যান্ডফিল গ্যাস। আমরা এটি কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’
বিজ্ঞানীরা দুই দশক ধরে বায়ুমণ্ডলে মিথেনের পরিমাণের স্থিরতা নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগছিলেন। এ রহস্যের সমাধান করা দরকার ছিল কারণ ২০০৬ সালের পর থেকে বায়ুমণ্ডলে মিথেনের পরিমাণ আবার বাড়তে শুরু করেছে।
মিথেনের পরিমাণ স্থির থাকার কারণ উদঘাটন করা গেলে সেই জ্ঞান কজে লাগিয়ে আবারও থামিয়ে দেয়া যেতে পারে বায়ুমণ্ডলে মিথেনের বৃদ্ধি। কারণ গ্যাসটি কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে অনেক বেশি পরিমাণ প্রায় ৩০ গুণ তাপ ধরে রাখতে পারে।
মূলত জীবাশ্ম জ্বালানির দহন, ধানের খড়, কয়লা খনি, গবাদি পশুর খামার হতে ও ক্রান্তীয় বনাঞ্চল পুড়ে ও ধ্বংসের ফলে বায়ুমণ্ডলে মিথেন নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়।
প্রফেসর জ্যাকসান বলছেন, মিথেনের অনেক উৎস আছে। তবে এই গ্যাস নির্গমনের হার এতো বেশি বেড়ে যাওয়ার পেছনে একটা কারণ হতে পারে – সম্ভবত কৃষি।
তিনি বলেন, “গত এক দশকে আমরা জীবাশ্ম জ্বালানীর নির্গমন দেখতে পেয়েছি। তবে আমরা মনে করি এর পেছনে বায়োলজিক্যাল সোর্সেস অর্থাৎ গবাদি পশু এবং ট্রপিক্যাল সোর্সেস অর্থাৎ ধানগাছ, জলাভূমি এবং গাছপালা, সম্ভবত বড় রকমের উৎস হতে পারে।”
জানা যায়, এর ক্রমাগত বৃদ্ধি পৃথিবীর তাপ বৃদ্ধি করে বিশ্বের সব জমাট বরফ গলিয়ে ফেলতে পারে, আর তাতে সমুদ্র তলের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে বাংলাদেশ, মালদ্বীপের মতো বিশ্বের অনেক নিচু জায়গাই কয়েক হাত পানির নিচে তলিয়ে যাবে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কার্বন ডাই অক্সাইডের তুলনায়, মিথেন গ্যাস, বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা এক শতাব্দী কাল সময়ব্যাপী ৩০ গুণ বেশি ধরে রাখতে পারে।
বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য যেসব গ্যাস দায়ী সেগুলোর মধ্যে মিথেন অন্যতম। শিল্প বিপ্লব শুরু হওয়ার পর এই গ্যাস নিঃসরণ বাড়লেও গত শতকের ৮০’র দশকে এর বৃদ্ধির প্রবণতা থেমে যায়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০০০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মিথেন গ্যাস নির্গমনের হার, একটা পর্যায়ে এসে থিতু হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু ২০০৭ সালের পর থেকে বায়ুমণ্ডলে এই গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা উর্ধ্বমূখী হয়ে দাঁড়ায়। তারপর ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে এসে এই হার খুবই দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রে গবেষকেরা আগেই সতর্ক করে বলেছেন, মিথেন গ্যাসের ছড়িয়ে পড়ার হার যদি কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা না যায়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ করার জন্য বর্তমানে যেসব লড়াই সংগ্রাম চলছে, তাতে খুব একটা ফল পাওয়া যাবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ও গবেষক রবার্ট জ্যাকসন বলছেন, ‘জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকানোর জন্য বর্তমানে যেসব কর্মসূচি চালানো হচ্ছে তাতে কার্বন ডাই অক্সাইডের ওপরেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। তবে আমরা যদি এখন এই মিথেন গ্যাসের দিকে নজর না দেই, তাহলে সেই ঝুঁকিটা থেকেই যাবে।’
তিনি বলেন, কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমন কমানোর মধ্য দিয়ে আমরা যে অগ্রগতি অর্জন করেছি, মিথেন গ্যাসের ছড়িয়ে পড়ার কারণে সেই অগ্রগতি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।”
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ওপর এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ কারণ কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর পাশাপাশি মিথেন গ্যাস নিয়েও চিন্তা করতে হবে। যদি এ বিষয়টি উপেক্ষিত রাখি, তাহলে আমাদের বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হবে। কৃষিপণ্য, তাজা শাকসবজি পচে গিয়ে মিথেন গ্যাস তৈরি হয়। এই গ্যাস যদি আমরা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারি, তাহলে অনেক কাজে লাগবে এবং এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য মিথেন গ্যাসের নিয়ন্ত্রণের ওপর নজর দেওয়া জরুরি।’
তারা বলেন, ‘কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস নির্গমনের সমস্যাটি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বৃদ্ধি পেয়েছে। মিথেন গ্যাসের ছড়িয়ে পড়ার হার যদি কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা না যায়, তাহলে তা আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ