ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ মিছিলে নিহতদের দায় নিতে চাচ্ছে না কেউ— না হেফাজতে ইসলাম, না আওয়ামী লীগ। নিহতদের দায় পরস্পর পরস্পের ঘাড়ে ফেলছে। এদিকে নিহতদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ বলে জানা গেছে।
সরকার বলছে, হেফাজতের সংঘাত ও সহিংসতায় ১৭জন মারা গেছে। এদিকে হেফাজত পাল্টা ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেন পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। তবে হেফাজতের তালিকা হিসাবে পুলিশের গুলিতে ১৫জন মারা গেছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকায় মুসল্লি ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনার প্রতিবাদে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মাদ্রাসার ছাত্ররা জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ মিছিল বের করে।
পুলিশ জানিয়েছে, জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ মিছিল থেকে হাটহাজারী থানায় ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নেতাকর্মীরা। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পাল্টা গুলি ছুঁড়েছে পুলিশ। এতে অন্তত ৮ জন গুলিবিদ্ধ ও ৪ জন নিহত হয়েছে।
এদিকে হাটহাজারীতে চারজনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে মাদ্রাসা ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করে৷ তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর করে৷ এরপর সদর পুলিশ ফাঁড়ির কাছে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হন৷ চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে ও ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় আন্দোলন মিছিলে অন্তত ৫ জন মারা গেছে বলে জানা যায়।
আরও বিভিন্ন স্থানের সহিংসতা ধরে হেফাজতের দাবি, এই সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৫ জন মারা গেছেন। তারা সবাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে মারা গেছেন। হেফাজত ১৫ জনের নামের তালিকা দিয়ে বলেছে, এদের বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ।
সরকারি হিসাবে, এসব সহিংসতায় প্রায় ৭৭ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যার মধ্যে ৭২ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে থানায় মামলা হয়েছে। তবে প্রাণহানির ঘটনা নিয়ে স্থানীয় পুলিশ স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। বিশেষ করে কাদের গুলিতে কারা নিহত হলো, এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য গণমাধ্যমকে দেয়নি। এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আনিসুর রহমান জাতীয় এক দৈনিককে বলেছেন, ‘মৃত্যুর সংখ্যাটি এখন বলতে চাইছি না। আপনারা খোঁজ নিন।’
তবে গত রোববার(৪ এপ্রিল) জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, এই তিন দিনে সহিংসতায় মোট ১৭ জন মারা গেছেন।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাতীয় ওই দৈনিককে বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামের জেলা পুলিশ ও জেলা বিশেষ শাখা (ডিএসবি) থেকে যে তথ্য এসেছে, তা ধরেই এই তালিকা করা হয়েছে। এদের সবারই মৃত্যু হয়েছে সংঘর্ষে।
এর আগে গত ৩০ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে এবং ২ এপ্রিল বিক্ষোভ সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দারুল আরকান ইসলামিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সাজিদুর রহমান বলেছেন, তিন দিনে সেখানে পুলিশ ও বিজিবির গুলিতে ১৫ জন মারা গেছেন। তাদের নাম-ঠিকানাসহ তালিকা প্রকাশ করে তিনি বলেন, যারা মারা গেছেন, বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষও তাদের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্ম আছেন, এটা তার প্রমাণ বলে তিনি দাবি করেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ‘ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হেফাজতের মৃত্যুবরণকারীদের নামের তালিকা’ অনুযায়ী হাটহাজারীতে ৪ জন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৩ জন মারা গেছেন।
২৮ মার্চ নিহত হন পাঁচজন। তাদের মধ্যে চারজন বিশ্বরোড মোড়ে এবং একজন কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে নন্দনপুরে মারা যান। নিহত ব্যক্তিরা হলেন সরাইল পাঠানপাড়া হাফিজিয়া মাদ্রাসার প্রাক্তন ছাত্র মো. আলামিন (১৯), রিকশাচালক লিটন (৩০), শ্রমিক কামালউদ্দীন (৩২), তাবলিগ জামাতের কালন মিয়া (৪০) ও কাপড়ের দোকানের কর্মচারী রাতিম (২২)।
অন্যদিকে হাটহাজারীতে চারজন নিহত হয়েছেন ২৬ মার্চ। তারা হলেন হাটহাজারী মাদ্রাসার নাসির উল্লাহ (২২), রবিউল ইসলাম (২২) ও কাজী মিরাজুল ইসলাম (২২) এবং দরজি দোকানি ওয়াহিদুল ইসলাম (১৮)।
এদিকে বিক্ষোভ মিছিলে সহিংসতার ঘটনায় হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক সহ ১৭ জনকে আসামি করে রাজধানীর পল্টন থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকাল সোমবার(৫ এপ্রিল) যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ উপ-দপ্তর সম্পাদক খন্দকার আরিফুজ্জামান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, উপরোক্ত আসামিগণসহ অন্যান্য অজ্ঞাতনামা আসামিগণ বায়তুল মোকাররমসহ ঢাকা মহানগরের বিভিন্নস্থানে তাণ্ডব চালিয়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ২৬ মার্চ বিকেল সাড়ে চারটায় ১নং আসামি মাওলানা মামুনুল হক বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভিতরে উক্ত আসামিসহ অজ্ঞাতনামা জামাত-শিবির-বিএনপি, জঙ্গি মৌলবাদী নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে মিলিত হয়ে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সারা দেশব্যাপী গুজব সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার পতনের লক্ষ্যে হামলার পরিকল্পনা করে।
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, ১নং আসামির প্রত্যক্ষ নির্দেশনায়, ষড়যন্ত্র ও পরিচালনায় ২নং থেকে ১৭নং আসামিসহ অজ্ঞাতনামা দুই থেকে তিন হাজার হেফাজত, জামাত-শিবির-বিএনপি জঙ্গি কর্মীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম হাটহাজারীসহ সারা দেশে রাস্তাঘাট, হাটহাজারী থানা, ব্রাহ্মনবাড়িয়া রেলস্ট্রেশন, ভূমি অফিস, সরকারি পাঠাগার, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান ও যাত্রাবাড়ীসহ দেশের নানাস্থানে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটতরাজ চালায়।
১নং আসামির নেতৃত্বে ২-১৭নং আসামিসহ অজ্ঞাতনামা আসামিগণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করে সংবিধান লঙ্ঘন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস, মসজিদ ভাংচুর করে দেশকে অস্থিতিশীল, অকার্যকর, মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার মাধ্যমে অবৈধ পথে সরকার উৎখাতের হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। সাক্ষীগণ ঘটনা প্রমাণ করিবে এবং তদন্তকালীন সময় বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ নিয়ে রাজনীতি করা এখন সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মানুষ নিয়ে রাজনীতি করা রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ফায়দা লুটিয়ে নিলেও মানুষ হত্যার দায় নিতে তাদের আপত্তি। সেটাও নিজেদের ফায়দার জন্যই।
তারা বলেন, প্রাণের চেয়ে বড় ক্ষতি নেই। বিগত জীবন আর ফিরে আসে না। মাদ্রাসাছাত্রদের প্রাণও প্রাণ, সে-ও বাংলাদেশের নাগরিক এবং তাদের মৃত্যু হয়েছে হামলার শিকার হয়ে।
তারা বলেন, বলপ্রয়োগের পথ ছাড়া উত্তেজনা মোকাবিলার আর কোনো পথ রাজনীতিবিদদের জানা নেই। প্রতিষ্ঠিত আইন-রাজনীতি ও নৈতিকতা যখন মানুষের অসন্তোষ মেটাতে পারে না, তখনই প্রান্তিক জনসাধারণ ওই সভ্যতা ও নৈতিকতা ত্যাগ করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমরা এটাই দেখেছি। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা যদি আদব ও নৈতিকতায় নিজেদের উন্নত ভাবেন, তাহলে কী করে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের মতো ভাঙচুরের পথে যান? ব্রাহ্মণবাড়িয়া বারেবারেই এ ধরনের সহিংসতার কবলে পড়েছে, বারেবারেই মাদ্রাসাছাত্ররা সেখানে সহিংসতার হাতিয়ার ও শিকার দুটোই হয়েছে।
তারা বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যর্থতা এই, এখানে বলপ্রয়োগ বা পাল্টা সহিংসতা ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিকতা, শাসনতরিকা বা প্রতিবাদের উপায় কারও জানা নেই। সমাজে ও রাজনীতিতে তাই আদিম হিংসার নৃত্য দেখা যাচ্ছে। এই আদিমতা আসলে ক্ষমতা দেখানোর আদিম অভ্যাসেরই আয়না-ছবি। ক্ষমতা যখন মানুষকে অসহায় করে তোলে, তখন সেই সব মানুষ নির্ভয় ও নির্লজ্জ হয়ে পাল্টা ক্ষমতা জাহির করে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ