ভারত সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার রপ্তানি সাময়িকভাবে স্থগিত করার পর সময়মত টিকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, টিকার পরের চালান কবে বাংলাদেশ হাতে পাবে, সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নন তিনি। সময়মত টিকা না পেলে চলমান টিকাদান কর্মসূচিতেও এর প্রভাব পড়বে। টিকার এই সংকট কাটাতে আমেরিকান কোম্পানি জনসন অ্যান্ড জনসন থেকে করোনাভাইরাসের টিকা কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফের মাধ্যমে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে এ টিকা কেনা হবে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
গত সপ্তাহে ভারত ভ্যাকসিন রপ্তানি বন্ধ করার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে ইউনাইটেড নেশন্স ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেনস ইমার্জেন্সি ফান্ড (ইউনিসেফ) এর মাধ্যমে জনসনের টিকা কেনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. হেলাল উদ্দিন জানিয়েছেন, জনসনের টিকা কেনার বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে এর প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি। এ জন্য সময় লাগবে।
গত নভেম্বরে নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধী ‘কোভিশিল্ড’ টিকার তিন কোটি ডোজ কিনতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করে সরকার। টিকার দাম পরিশোধ করা হয় অগ্রিম। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশে আসার কথা। গত জানুয়ারিতে ৫০ লাখ ডোজ টিকা এলেও ফেব্রুয়ারিতে এসেছে ২০ লাখ ডোজ। চলতি মাসে কেনা টিকার চালান এসে পৌঁছেনি। তবে দুই দফায় বাংলাদেশকে ৩২ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে দিয়েছে ভারত। আগামী ৭ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয় ডোজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। তবে চুক্তি অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি ও মার্চে টিকা সরবরাহ করতে পারেনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট। এ দুই মাসে ৮০ লাখ ডোজ টিকা কম সরবরাহ হয়েছে। এতে দেশে চলমান টিকা কার্যক্রমে প্রথম পর্যায়ের দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার সারাদেশে ৫০,৭৫২ জনকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এটি গত ৪২ দিনের গড় টিকাদানের অর্ধেকেরও কম। ৭ ফেব্রুয়ারি টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর বুধবার পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ১২৭,৮৬৭ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি থাকলেও ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে সময়মত টিকা পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, মার্চের শেষে বাংলাদেশকে দুই কোটি ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেওয়ার কথা ছিল কোভ্যাক্সের।
ভারত রপ্তানি বন্ধ করার পর কোভ্যাক্স ই-মেইলে বাংলাদেশকে জানিয়েছে যে, ভারত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশকে টিকা সরবরাহ করা হবে। টিকার সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশের চলমান টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটেই অক্সফোর্ডের টিকার বিকল্প হিসেবে জনসনের টিকা আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
ওই কর্মকর্তারা বলেন, দেশের কোনো মানুষ যাতে টিকাদান কর্মসূচির বাইরে না থাকে, সে জন্য আরও তিন কোটি ডোজ টিকা আমদানি করতে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই নির্দেশনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আগে থেকেই জনসনের টিকা কেনার বিষয়ে আলোচনা শুরু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ভারত ২৫ মার্চ টিকা রপ্তানি বন্ধ করার পর জনসনের টিকা কেনার উদ্যোগে গতি বেড়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, অর্থ মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্নিষ্ট সব পক্ষ জনসনের টিকা কেনার বিষয়ে একমত হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ জনসনের টিকা পাওয়া যাবে।
কোভিড-১৯ মোকাবেলায় এডিবি বাংলাদেশকে ৯৪০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের অঙ্গীকার করেছে, সেখান থেকে জনসনের ভ্যাকসিন মূল্য পরিশোধ করা হবে। এপ্রিল মাসে এ ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইউনিসেফের প্রকিউরমেন্ট সাপ্লাই ডিভিশনের মাধ্যমে টিকা কেনা হবে। এ ছাড়া টিকা কেনার জন্য জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা ৫০ কোটি ডলার, এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক (এআইআইবি) ৫০ কোটি ডলার, ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক ২৫ কোটি ডলার অর্থায়ন করার আগ্রহ দেখিয়েছে। বাংলাদেশের টিকা কেনার কাজে অর্থায়নে ফ্রান্স সরকারও আগ্রহী। তবে দেশটি কী পরিমাণ অর্থায়ন করবে, তা বলেনি।
গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার জনসন অ্যান্ড জনসনের তৈরি টিকার অনুমোদন দিয়েছে। এ টিকা সাধারণ রেফ্রিজারেটরে রাখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আক্রান্ত হওয়ার হার ঠেকাতে ৬৬ ভাগ কার্যকর এই টিকা। বেলজিয়ামের প্রতিষ্ঠান জ্যানসেন এটি তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে আগামী জুন নাগাদ ১০ কোটি ডোজ দিতে রাজি হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ টিকা নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে। কোভ্যাক্সও ৫০ কোটি ডোজ নিতে চায়। ফলে আগামী সেপ্টেম্বরের আগে এ প্রতিষ্ঠান থেকে টিকা পাওয়ার সুযোগ নেই।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, জনসনের টিকার কোল্ডচেইন অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের মতোই, ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করা সম্ভব, সাধারণ রেফ্রিজারেটরেই এই কোল্ডচেইন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। একক ডোজের এই টিকার আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য ৬-১০ ডলার। বাংলাদেশ ১০ ডলার দাম ধরে এই টিকা কেনার উদ্যোগ নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারকে একটি ভ্যাকসিনের ওপর নির্ভর না থেকে একাধিক উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের পরামর্শ দিয়ে আসছেন। এই প্রেক্ষাপটে জনসন অ্যান্ড জনসন এর ভ্যাকসিন আমদানির সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক বলে মনে করেন তারা।
তারা বলেন, ‘জনসন অ্যান্ড জনসন এর ভ্যাকসিন আমদানির পরিকল্পনা করা হলে সেটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। আমাদের জন্য এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো বিকল্প হলো জনসনের ভ্যাকসিন। কারণ এই ভ্যাকসিন সিঙ্গেল ডোজ এবং আমাদের এ ভ্যাকসিন সংরক্ষণের কোল্ড চেইন রয়েছে। জনসনের ভ্যাকসিন দেরিতে তৈরি হওয়ায় এর কার্যকারিতা বেশি। এই ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা ৯০%’।
তারা বলেন, ‘সরকার ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কেনার চেষ্টা করছে। এতে জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিন পাওয়া গেলে সেটি আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো হবে। সিঙ্গেল ডোজের ভ্যাকসিন দেয়া হলে ভ্যাকসিন কার্যক্রম পরিচালনা আরো সহজ হবে’।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৫৮
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ