স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিকে ঘিরে সংঘটিত নারায়ণগঞ্জে নাশকতা ও তাণ্ডবের ঘটনায় পুলিশের মামলায় হেফাজতের কোনও নেতাকর্মীর নাম নেই, মামলায় বিএনপি আর জামায়াতে ইসলামের নেতাকর্মীদের নাম। হেফাজতে ইসলামের হরতালে নারায়ণগঞ্জে সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পুলিশ ছয়টি মামলা দায়ের করে। মামলায় বিএনপির সাবেক সাংসদ গিয়াস উদ্দিন ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মামুন মাহমুদসহ বিএনপি-জামায়াতের ১৩৬ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল সমর্থনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে হরতাল সমর্থনকারীদের দিনভর সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের করা ছয়টি এবং র্যাবের করা একটি মামলা করা হয়। সোমবার রাতে পৃথকভাবে এসব মামলা দায়ের করা হয় । গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নিশ্চিত করেছেন জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম।
৭টি মামলার মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় পুলিশ বাদী হয়ে ৫টি ও র্যাব বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। অপর মামলাটি রুজু করা হয়েছে রূপগঞ্জ থানায়। এ সময় মামলার প্রতিটিতে ২০ থেকে ২৫ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৫শ’ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে র্যাবের মামলায় কারও নাম উল্লেখ না করে অজ্ঞাত ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক মামুন মাহমুদসহ বিএনপি-জামায়াতের ১৩৬ জনের নাম আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
পুলিশ ও বিএনপির সূত্রগুলো জানায়, মামলায় পুলিশ উল্লেখ করেছে যে, হরতালে হেফাজতের ব্যানারে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, জামায়েত ইসলামী ও ছাত্র শিবিরসহ তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা অবস্থান নেয়। তারাই মূলত সড়ক অবরোধ করে গাড়ি ভাঙচুর করে আগুন ও পুলিশের কাজে বাধা দেয়।
নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদুল আলম জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনায় সাতটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি পুলিশ বাদী হয়ে করেছে আর একটি র্যাব বাদী হয়ে করেছে। এর মধ্যে ছয়টি মামলা সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ও একটি রূপগঞ্জ থানায় হয়েছে। এই সাত মামলায় ১৫৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাত আছে আরও প্রায় চার হাজার।’
কতজন গ্রেপ্তার হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রূপগঞ্জের মামলায় বিএনপির চার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জের মামলাতেও চার জন গ্রেপ্তার হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।’
হেফাজতের হরতালে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের কেন আসামি করা হয়েছে, প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওইদিন যারা উপস্থিত ছিল তাদের আসামি করা হয়েছে। হেফাজতের কিছু কর্মী, বিএনপি ও জামায়াতের কিছু লোকজন ছিল, আমরা যাদের দেখেছি তাদের নাম এজাহারে আছে। যারা ওখানে ছিল এবং ইন্ধন দিয়েছে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের নামে মামলা করা হয়েছে। আমরা রাজনৈতিক পরিচয় দেখিনি, আমরা দেখেছি কারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের আসামি করা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ, মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য ও ছবির উপর ভিত্তি করে মামলা হয়েছে।’
কর্মসূচি হেফাজতের হলেও তাদের কোনো নেতার নামে কেন মামলা নেই? জবাবে তিনি বলেন, ‘তারা (হেফাজত) বের হয়নি। ৫০০ থেকে ৭০০ জনের মতো তারা কেন্দ্রীয় মসজিদে ছিলেন। তারা আমাদের কথা দিয়েছিলেন বের হবে না। প্রত্যেকটা থানা এলাকায় যারা বের হয়েছে, আমরা কথা বলেছি তারা ঠিকই ১০-১১টার মধ্যে মোনাজাত করে চলে গেছে। কিন্তু ভাঙচুর হয়েছে ১২টার পরে। সেখানে দুই-একজন পাবেন যারা হয়তো হেফাজতের সঙ্গে জড়িত। আর বেশির ভাগই প্যান্ট-শার্ট পরা, তারা হেফজতের লোক না। সুতরাং যারা করেনি হামলা তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার তো কোন কারণ নাই। তারা কথা দিয়েছিলেন, কথা রেখেছেন। নারায়ণগঞ্জের যিনি আমির (হেফাজত) তিনি বের হননি। তিনি সব জায়গায় ফোনে বলে দিয়েছেন, “ভাই তোমরা মুনাজাত করে চলে যাও।” উনারা অহিংস, নারায়ণগঞ্জে তার প্রমাণ দিয়েছেন।’
জেলা পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় আমরা বিভিন্ন স্পট থেকে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। বিশেষ করে রোববার বিকালে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার পর যানবাহন চলাচল শুরু হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইলে আকস্মিক ফিল্মি কায়দায় দুর্বৃত্তরা বেশ কয়েকটি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে। আমরা পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। শুধু হেফাজতই নয়, এই তাণ্ডবের নেপথ্যে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে অন্য কোনো গোষ্ঠী জড়িত বলেও আমরা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছি। তাদেরও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
এ ঘটনায় আন্দোলনকারীদের নিবৃত্ত করতে পুলিশ শটগানের রাবার বুলেট ও চাইনিজ রাইফেলের ৪ হাজার রাউন্ড গুলি ও ১৫০ রাউন্ড টিয়ারশেল ছুড়েছে বলে জেলা পুলিশ জানিয়েছে।
পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম জানান, বিনা উস্কানিতেই হরতাল সমর্থনকারীরা রোববার তাণ্ডব চালিয়েছে। আমরা বারংবার তাদের শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করার আহ্বান জানালেও তারা ছিল মারমুখী। বিশেষ করে হরতালকারীরা সারা দিনে প্রায় অর্ধশত যানবাহন ভাংচুর ও বহু যানবাহনে আগুন দিয়েছে।
এসপি জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর বারবার চড়াও হয়েছে তা গণমাধ্যম কর্মীরাও সাক্ষী। কারণ বহু গণমাধ্যম কর্মীদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে, গণমাধ্যমের গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে।
পুলিশ সুপার জানান, পুলিশের পাশাপাশি যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারাও মামলা করবেন বলে আমরা জানতে পেরেছি।
বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহবায়ক অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার জাতীয় ওই দৈনিককে বলেন, ‘এটা সরকারের একটি সাজানো নাটক। সরকার নিজেরা ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপিকে হয়রানি করার জন্য এ নাটক করা হয়েছে। বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলসহ অঙ্গ সংগঠনের কোনো নেতাকর্মী সেদিন উপস্থিত ছিল না। হরতালের ব্যাপারে বিএনপির কোনো নির্দেশনা ছিল না। মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। সরকার ব্যর্থতা ঢাকা দেওয়ার জন্য এগুলো করছে। বিএনপিকে হয়রানী করার জন্য এগুলো করছে।’
এদিকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিকে ঘিরে সংঘটিত নাশকতা ও তাণ্ডবের ঘটনায় বিভিন্ন জেলায় দায়ের করা পুলিশের মামলায় হেফাজতের কোনও নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়নি। মামলায় ঘটনার বর্ণনা থাকলেও আসামি সব অজ্ঞাত। হাটহাজারীতে সংঘর্ষের ঘটনায় সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনও মামলাই হয়নি।
হামলাকারী কারা ছিল, সেটি মোটামুটি স্পষ্ট থাকলেও মামলার আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতদের। বিএনপি বা অন্য দলের হরতালে সহিংসতার ঘটনায় করা মামলায় দলের শীর্ষ নেতাদের হুকুমের আসামি করা হলেও হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের এবার সেভাবে আসামি করা হয়নি।
পুলিশ বলছে, ঘটনা তদন্ত করে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাদেরই আসামি করা হবে। বর্তমানে পর্যালোচনা চলছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। হেফাজতের আড়ালে জামায়াত-বিএনপি এই হামলা করেছে বলেও কোনও কোনও পুলিশ কর্মকর্তা দাবি করেছেন।
শুক্র ও রোববার হেফাজতে ইসলামের হরতালে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাণ্ডবের ঘটনায় করা মামলায় সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নাম না থাকার কী কারণ, সেটি ব্যাখ্যা করেছেন পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ।
তিনি বলেছেন, এজাহারে নাম নেই বলে তদন্তে কারও নাম আসবে না, এমন নয়।
বেনজীর আহমেদ বলেছেন, ‘যারা অনস্পট ছিল তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আমাদের দেশে কোনও কাজ হলে দশ রকম কন্ট্রোভার্সি হয়। আমরা এক্ষেত্রে চাইনি এরকম কিছু হোক। তদন্ত চলছে। তদন্তে হেফাজতের নেতাদের বা নির্দেশদাতাদের নাম আসলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা কাউকে বাদ দেইনি।’
আজ বুধবার (৩১ মার্চ) ঢাকার সিএমএইচে চিকিৎসাধীন আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এই কথা বলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের নির্দেশেই এসব মামলায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এটা নতুন করে বলার কিছু নেই। সরকারের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলাম আন্দোলন বিদ্রোহ করলেও সরকার চাইছে না এখনি হেফাজতের সাথে সম্পর্কের ইতি টানতে। হেফাজতের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করে সরকার চাইছে না এতদিনের পরিশ্রম এখনি বৃথা যাক। তাই মামলা ভিন্ন দিকে গড়িয়ে বিতর্ক অন্যদিকে ঘুরাতে চাচ্ছে। নিজেদের সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে বিএনপি জামাতের ঘাড়ে চাপিয়ে আসল ঘটনা ভিন্ন খাতে ঢালতে চাচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ