জামিন জালিয়াতি, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শাস্তির বিধান জানা সত্ত্বেও এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটে চলেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। ভুয়া নথি দাখিল ও হাইকোর্টের জামিন আদেশ হুবহু নকল করে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে আসামিরা। এমনকি খোদ বিচারপতিদের সিল-স্বাক্ষর নকল করেও চলছে জামিনবাণিজ্য। জাল-জালিয়াতির ঘটনা একের পর এক ঘটেই যাচ্ছে। আদালতে জামিন জালিয়াতির একাধিক ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হলেও এর সঙ্গে জড়িতরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি জামিন জালিয়াতি ধরা পড়ার পর বিষয়টি আবার নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে। আবার অনেক সময় জালিয়াতচক্র ধরা পড়ার পরও তাদের নামে মামলা হয় না। মাঝেমধ্যে মামলা হলেও তদন্ত শেষ করতে পেরিয়ে যায় বছরের পর বছর। ফলে বিচারকাজ শেষ হতে এক-দেড় যুগ পেরিয়ে যাওয়ার নজিরও রয়েছে। সবচেয়ে বেশি জামিন জালিয়াতির ঘটনা ঘটে হত্যা, মাদক, অস্ত্র, ধর্ষণ ও অপহরণ মামলায়।
কাতারে ২০১৪ সালে চারজন মিলে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে বাংলাদেশি ঠিকাদার আব্দুর রাজ্জাককে হত্যা করে। হত্যাকারী ঢাকার দোহার উপজেলার রুবেল, রিপন, দীন ইসলাম ও ঠাকুরগাঁওয়ের রাশেদুল হক পরদিন রাজ্জাকের পাসপোর্ট ও আইডি কার্ড নিয়ে দেশে চলে আসে। ফিরেই তারা স্বজনদের কাছে খুনের কথা স্বীকার করে এবং রাজ্জাকের বৃদ্ধ বাবা দোহারের গাজীরটেক এলাকার আনোয়ার হোসেনকে হত্যার হুমকি দেয়।
এ ঘটনায় আনোয়ার হোসেন মামলা করলে দুজন গ্রেফতার হয়। এরই মধ্যে হত্যা মামলায় কাতারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় ওই চারজনকে। সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে তথ্য গোপন করে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে যায় রিপন। বিষয়টি নজরে এলে তার (রিপন) জামিন বাতিল করে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন আদালত।
এভাবে তথ্য গোপন করে অথবা নথি জালিয়াতি করে উচ্চ ও নিম্ন আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে আসামিরা। জালিয়াতি বন্ধে সুপ্রিমকোর্ট থেকে বিভিন্ন সময়ে নির্দেশনা দেওয়াসহ একাধিক মামলা হয়েছে। কিন্তু এরপরও থামছে না জামিন জালিয়াতি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত কয়েক মাসে অন্তত পাঁচটি জামিন জালিয়াতির ঘটনা হাইকোর্টে ধরা পড়েছে। শুধু হত্যা মামলায় নয়, জাল নথি সৃজনের পাশাপাশি তথ্য গোপন ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অস্ত্র, ধর্ষণ ও মাদক মামলাসহ বিভিন্ন গুরুতর মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিন নেওয়া হচ্ছে। জামিন নেওয়ার ক্ষেত্রে ভুয়া এফআইআর, চার্জশিট, জব্দ তালিকা দাখিল করা হচ্ছে।
অভিযোগের গুরুত্ব কমিয়ে তৈরি করা কাগজপত্র দেখিয়ে আদালতকে বিভ্রান্ত করে পক্ষে নেওয়া হচ্ছে আদেশ। ফৌজদারি বিবিধ শাখায় এসব ঘটনা বেশি ঘটছে। এসব জালিয়াতিতে একাধিক চক্র জড়িত। জামিন আদেশের কপি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এর আগে ফৌজদারি মিস শাখার জমাদার মঞ্জু রানী কৈরীকে বরখাস্ত করে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। এরপর কিছুদিন জামিন জালিয়াতির ঘটনা থেমে ছিল। সম্প্রতি আবারও বেশ কয়েকটি জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে।
সূত্র জানায়, হাইকোর্টের নির্দেশে নথি ও জামিন জালিয়াতির ঘটনায় এ পর্যন্ত প্রায় ৬০টির মতো মামলা করেছে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। এর মধ্যে ফৌজদারি বিবিধ শাখা থেকে ৩৯টি, রিট শাখা থেকে নয়টি, ফৌজদারি আপিল শাখা থেকে দুটি এবং অন্যান্য শাখা থেকে ১০টি মামলা করা হয়। এসব মামলা তদন্ত ও বিচারাধীন রয়েছে।
এছাড়া গত বছরের নভেম্বরে প্রতারণার মাধ্যমে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেওয়ার ঘটনায় সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী, গোপালগঞ্জ আদালতের চার কর্মকর্তাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। শাহবাগ থানায় মামলা দুটি হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মামলাগুলো ঝুলে আছে বিচারিক আদালতে, নিষ্পত্তি খুবই কম।
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জামিন জালিয়াতির মামলা বছরের পর বছর বিচারাধীন থাকে এবং জড়িতদের শাস্তির হার খুব কম হওয়ায় এসব ঘটনা কমানো সম্ভব হচ্ছে না। তাদের দাবি, জালিয়াতচক্রকে খুঁজে বের করে যদি দ্রুত আইনের আওতায় আনা যায় তাহলে এসব কাজ পরবর্তীতে আর কেউ করবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যেসব মামলায় নিম্ন আদালতে আসামিদের জামিন হয় না, ওইসব মামলার কাগজপত্র জালিয়াতি করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের মাধ্যমে উচ্চআদালত থেকে জামিনের ব্যবস্থা করা হয়। আর এ জন্য আসামিপক্ষের লোকজনের কাছে পাঁচ লাখ থেকে শুরু করে আরও বেশি টাকা নেয়া হয়।
মূলত বিভিন্ন মামলায় দণ্ডিত আসামিরা জামিন নেয়ার ক্ষেত্রে মামলার ভুয়া এফআইআর, চার্জশিট, জব্দ তালিকা দাখিল করে। মামলার এজাহারের কিছু স্পর্শকাতর শব্দ বদল করে তা হাইকোর্টে জমা দিয়ে জামিন নেন।
তথ্য গোপন করে জামিন আবেদন করায় ফেঁসে যান কামরুল হাসান নামের এক আসামি। জানা যায়, প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের মামলায় চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি নিম্ন আদালতে কামরুলের জামিন আবেদন নামঞ্জুর হয়। পরে এ সূত্রে তিনি হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের অপর একটি দ্বৈত বেঞ্চে জামিন আবেদনটি উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ হয়।
এ তথ্য গোপন করে নিম্ন আদালতের জামিন নামঞ্জুরের একই আদেশ দেখিয়ে ১৫ মার্চ বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চে জামিন আবেদন করে আসামিপক্ষ। তথ্য গোপনের বিষয়টি নজরে এলে ওই মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি কোনো আদালতে জামিন আবেদন করতে পারবেন না বলে আদেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এ আদালতে কামরুলের আইনজীবী দুই মাস জামিন আবেদন পরিচালনা করতে পারবেন না বলেও সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।
হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলমের নাম উল্লেখ করে ১৪ ফেব্রুয়ারি জামিন পান বগুড়া সদরের আমিনুর ইসলামসহ ৩০ আসামি। কিন্তু ওইদিন ওই কোর্ট থেকে এমন কোনো জামিনাদেশ হয়নি। এমনকি সেখানে আইনজীবীদের যে নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেটির কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এ মামলায় ভুয়া আগাম জামিননামা তৈরির ঘটনায় আমিনুর ইসলাম, আব্দুল আলিম, আনোয়ার মণ্ডলসহ ৩০ জনকে গ্রেফতার করতে ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। নির্দেশের ৭ দিনের মধ্যে তাদের গ্রেফতার করতে বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) বলা হয়। এছাড়া বিষয়টি তদন্ত করতে বগুড়ার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকেও নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৬ মার্চ নির্ধারিত দিনে প্রতিবেদন না আসায় আদালত উষ্মা প্রকাশ করেন।
মাদক মামলার আসামি সফিউল্লাহ খান ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। জামিননামা আদেশ নিম্ন আদালতে (গোপালগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত) পাঠানো হয়। এরপর আসামি শফিউল্লাহ খানের জামিননামা দাখিল করলে তা গ্রহণ করা হয়। এ সময় আদালতের দৃষ্টিতে আসে যে, আসামির দখল থেকে ২২০০ পিস ইয়াবা উদ্ধারের অভিযোগ থাকলেও হাইকোর্টের আদেশে ২২ পিস ইয়াবা উদ্ধারের কথা রয়েছে।
এরপর গোপালগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বিষয়টি হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে অবহিত করেন। রেজিস্ট্রার জেনারেল বিষয়টি সংশ্লিষ্ট জামিন দেওয়া বিচারপতিদের অবহিত করেন। পরে আদালত জাল-জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার জন্য নির্দেশ দেন।
মাদক মামলায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার আসলাম শেখ ও রমজান মোল্লা ৬ জানুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন। গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের নজরে আসে যে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে তারা জামিন নিয়েছেন। তদন্ত করে এর সত্যতা পাওয়া গেলে হাইকোর্ট জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ দেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আসলে বিভিন্ন সময় দেখা যায় উচ্চআদালতের কিছু আইনজীবী মিথ্যা তথ্য দিয়ে, তথ্য গোপন করে আসামির জামিন করান। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। টাকার জন্য নৈতিকতা বিলিয়ে দেয়া ঠিক নয়। সুতরাং যারা এসব অনিয়মের সাথে জড়িত তাদের ব্যাপারে আদালত যদি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ না নেন, সনদ বাতিল বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না করেন, তাহলে এ ধরনের ঘটনা কমবে না। তাই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে কতৃপক্ষকে অনুরোধ জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৪১১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ