বিচারিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়া হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয়নি ২৬ মাসেও। দুর্নীতি ও গুরুতর পেশাগত অসদাচরণের অভিযোগ ওঠায় ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট তাদের বিচারকাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এই সিদ্ধান্ত দেন। পরে ওই তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্তকাজ শুরু হলেও তা এখন ‘ফাইলবন্দি’ হয়ে আছে। তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কেও সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের কাছে কোনো তথ্য নেই। ওই তিন বিচারপতি বিচারকাজে না থেকেও বেতন-ভাতা, আবাসন, যানবাহনসহ আনুষঙ্গিক সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন।
বিচারকাজ থেকে প্রত্যাহার হওয়া হাইকোর্টের এই তিন বিচারপতির একজন হলেন বিচারপতি একেএম জহিরুল হক। সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, তিনি ২০১৯ সালের আগস্টে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর কিছুদিন ছুটিতে ছিলেন। পরে আর ছুটি নেননি। আবার তিনি বিচারিক দায়িত্বেও নেই। মাঝেমধ্যে তিনি সুপ্রিম কোর্টে তাদের জন্য নির্ধারিত অফিস কক্ষে আসেন এবং কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করে চলে যান। চাকরি বিধি অনুযায়ী, বিচারপতি একেএম জহিরুল হক ২০২৬ সালের ৩১ জানুয়ারি অবসরে যাওয়ার কথা।
যা ঘটেছিল
সূত্র জানায়, বিধিবহির্ভূতভাবে অধস্তন আদালতের মামলায় হস্তক্ষেপ করে ডিক্রি পাল্টে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের বিরুদ্ধে। তিনি হাইকোর্টে একটি দ্বৈত বেঞ্চে দায়িত্ব পরিচালনা করতেন। এই অভিযোগ তদন্তের জন্য প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীর নেতৃত্বে এক সদস্যের কমিটি গঠন করেন। কমিটি এখনও তার বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেনি।
২০১৯ সালের ১৬ মে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিম্ন আদালতের মামলায় হস্তক্ষেপ করে ডিক্রি পাল্টে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল হাইকোর্টের বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি একেএম জহুরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চের বিরুদ্ধে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ সংক্রান্ত এক রিট মামলায় অবৈধ হস্তক্ষেপ করে ডিক্রি জারির মাধ্যমে হাইকোর্টের ওই বেঞ্চ রায় পাল্টে দেন বলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে অভিযোগ তুলেছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ সংশ্লিষ্ট অর্থ ঋণ আদালতের (নিম্ন আদালত) মামলাটির সব ডিক্রি ও আদেশ বাতিল ঘোষণা করেছিলেন।
পরবর্তীতে সূত্র মতে, এই তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধানের প্রেক্ষাপটে প্রধান বিচারপতি মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে তাদের বিচার কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্তের কথা অবহিত করা হয় এবং পরবর্তীতে তারা ছুটির প্রার্থনা করেন।
সিনিয়র আইনজীবীরা বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম একসঙ্গে তিন বিচারপতিকে বিচারকার্য থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত হলো। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করার বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, বিচার বিভাগের আরো অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
কেবল তিন বিচারপতিই নন, আরো অনেক বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে বিষয়টি প্রধান বিচারপতিকে অবহিত করেছি। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রকাশ্যে দুর্নীতি করেন।
আইনজীবীরা তাদের কাছে প্রতিদিন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অপরদিকে, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগের অনুসন্ধান বিচার বিভাগের অন্যদের জন্য একটি বার্তা বলে মন্তব্য করেছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
কী পরিণতি হতে পারে?
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিচারপতি বলেন, বিষয়টি ঝুলে থাকায় তিনি এখনও বিচারপতি পদে রয়েছেন। তাই তাকে এড়িয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই। আগামী ৩০ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি অবসরে যাবেন। এরপর হয়তো এই বিচারপতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
সুপ্রিম কোর্টের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণ-সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আপিল বিভাগের রায়ে বাতিল হওয়ায় কোন প্রক্রিয়ায় বিচারপতি অপসারণ করা হবে তা নিয়ে শীর্ষ পর্যায়ে মতভেদ রয়েছে। একইসঙ্গে তদন্ত প্রক্রিয়া নির্ধারণ নিয়েও। এ জন্য তার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি।
তবে আইনজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলই বর্তমানে বিচারপতি অপসারণে সংবিধানসম্মত পদ্ধতি। কারণ, আগে ওই পদ্ধতিতেই বিচারপতি অপসারণ হতো।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে (১১ অক্টোবর ২০২১ এ প্রকাশিত) বলেন, ‘সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলা আপিল বিভাগের রায়ে বাতিল হওয়ার পর বিচারপতি অপসারণের জন্য এখন সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল হয়েছে। অভিযুক্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা নিতে হলে সেটা সংবিধানসম্মত উপায়ে নিতে হবে। যদি সেটা নিতে হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করতে হবে।’
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কার্যক্রম প্রসঙ্গে শাহ্দীন মালিক বলেন, এই প্রক্রিয়া অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পরবর্তী দুইজন জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে নিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হবে। তারা অভিযুক্ত বিচারপতির কাছে অভিযোগের বিষয়ে জবাব চাইবেন। পরে প্রয়োজনে তাদের সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করবেন।
এর আলোকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যদি অভিযুক্তর বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগের বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে মতামত পাঠাবেন। এরপর রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত কার্যকর করবেন।
প্রেস কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান ও আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমদ বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেছে, কিন্তু সেই আবেদনের শুনানি হয়নি এখনও। অর্থাৎ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের আদেশ এখনও বহাল রয়েছে। এ কারণে ওই রায় অনুসারে হাইকোর্টের এই বিচারপতির বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতে হলে অবশ্যই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করতে হবে।
বাহাত্তরের মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ওই ক্ষমতা দেওয়া হয় রাষ্ট্রপতির হাতে। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ওই ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে। এরপর আপিল বিভাগের এক রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা হলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ব্যবস্থা রেখে দেওয়া হয়।
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয় সংসদের কাছে। সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবীর করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। এরপর ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। পরে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই ওই আপিল খারিজ করে রায় দেন আপিল বিভাগ। এরই ধারাবাহিকতায় একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের রায় রিভিউ চেয়ে আবেদন করা হয়, যা এখনও শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৪৫
আপনার মতামত জানানঃ