আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে জোর করে ভোট গ্রহণের অভিযোগ নতুন নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনসভায় প্রকাশ্যে জোর করে ভোট নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এবিষয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভিডিও ভাইরালও হয়েছে। এবারও তেমনি একটি ভিডিওতে দেখা গেল, এক আওয়ামী লীগ নেতা পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে নৌকায় ভোট নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার(১৮ মার্চ) এমন ঘোষণা সম্বলিত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এমন বক্তব্য নিয়ে নেট দুনিয়ায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে নৌকায় ভোট নেওয়ার এই ঘোষণা দেন কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার হলদিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহ আলম। ১৬ মার্চ রাতে হলদিয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের হাতিরঘোনা এলাকায় নির্বাচনের একটি প্রস্তুতি সভায় তিনি এই ঘোষণা দেন। শাহ আলম সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলমের ছোট ভাই। তিনি ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সহ-সভাপতি। ২০১৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। এর আগে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ছিলেন।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না হলেও শাহ আলম আগাম মাঠে নেমেছেন। ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বক্তব্যে সরকার ও পুলিশের কথা এবং নিজের ও তার ভাইয়ের ক্ষমতা সম্পর্কে বলেন।
গত ১৬ মার্চ রাত ১১টায় হলদিয়া পালং ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের হাতির ঘোনা এলাকার একটি উঠান বৈঠকে দেয়া ওই ভিডিও বক্তব্যে তাকে বলতে শোনা যায়, ভোট কোনো জায়গায় ছিঁড়ে নিতে দেয়া হবে না। নিলে কে নিতে পারবে? আমি পারব। কী জন্য পারব? সরকার কার? শেখ হাসিনার সরকার, নৌকা মার্কার সরকার। ভোট নিতে পারলে, জোর করতে পারলে নৌকা মার্কার লোকজনে পারবে। নাকি চেয়ার মার্কা, গ্লাস মার্কার মানুষ পারবে? দেশটা এবং সরকারি বাহিনী পুলিশ সরকারের। এরা নৌকা মার্কার না? ভোট নিতে চাইলে এরা পিটিয়ে নিতে পারে।
১ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি বলছেন, ‘কেউ ভোট কেটে নিতে পারবে না। নিতে চাইলে নৌকা মার্কা-ই ভোট কেটে নিতে পারবে। পুলিশ সরকারি বাহিনী আর সরকার এখন নৌকার, সরকার শেখ হাসিনার। কিন্তু সেটাও হতে দেব না। জনগণ ভোট দিয়ে নৌকাকে জয়ী করবে। আপনাদের দোয়াতেই এটি সম্ভব।’
পূর্বের বক্তব্যের সঙ্গে লাগিয়ে দেওয়া একই বৈঠকে আরেকটি বক্তব্যে তিনি আরো বলেন, আমার ভাই যিনি ঢাকায় ছিলেন তিনি এখন ওয়াশিংটন। সেখানে বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশ-ভারত-ভুটান-নেপাল-শ্রীলঙ্কা এ পাঁচ দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি ২৯ লাখ সরকারি কর্মকর্তার বস্ ছিলেন। তার সহকর্মীরা স্তরে স্তরে দায়িত্বপালন করছেন। ওনার অনুগতরা আরো ১০ বছর দেশ পরিচালনায় থাকবে। সুতরাং আমার ক্ষমতা যারা কমে গেছে বলে প্রচার করছে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। আমার ক্ষমতা আছে, সামনেও থাকবে। আপনারা শুধু আমার জন্য দোয়া করবেন।
শাহ আলমের এই বক্তব্যে বিব্রত স্থানীয় আওয়ামী লীগও। হলদিয়াপালং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ভোটের আগাম প্রচারণা সভায় বর্তমান চেয়ারম্যান শাহ আলমের এ রকম বক্তব্যে দলের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হয়েছে।
উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, ‘নৌকার মনোনয়ন কে পাবে তা দলের নির্বাচনী বোর্ড ঠিক করবে। ঘরোয়া বৈঠকে নিজস্ব লোকজনকে অনুপ্রাণিত করতে অনেকে অনেক ধরনের বক্তব্য দিতেই পারেন। সেটা একান্ত ব্যক্তিগত। দলীয় ফোরামের বাইরে বলা কথা নিয়ে দলের ভেতর হইচই করা বোকামি।’
উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, নৌকার মনোনয়ন কে পাবে, সেটি দলের নির্বাচনী বোর্ড ঠিক করবে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা তার (শাহ আলম) ঘরে এসে নৌকা দিয়ে যাবেন, এমন বক্তব্য শুধু শিষ্টাচারবহির্ভূত নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধও বটে। এই ধরনের বক্তব্য দিয়ে তিনি দলীয় প্রধানকে হেয় করেছেন।
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ইরফান উদ্দিন বলেন, এ ধরনের বক্তব্য নির্বাচন কমিশন সমর্থন করে না। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হবে।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহমেদ সঞ্জুর মোরশেদ বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যানের বিরূপ ও অশালীন মন্তব্য করা ঠিক হয়নি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, এবারের পৌরসভা নির্বাচনকে ঘিরে সরকারদলীয় প্রার্থী ও নেতাকর্মীরা কেন্দ্র দখল, ভোট চুরি করার কৌশল, নৌকায় ভোট না দিলে এলাকা ছাড়ার হুমকি প্রকাশ্যেই দিয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের সার্বিক এক পরিস্থিতি উঠে আসে। দেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র যে সঠিক প্রক্রিয়ায় আগাচ্ছে না তারই নমুনা হিসাবে এসব তুলে ধরতে চান বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, ঠাকুরগাঁও পৌরসভা, কুষ্টিয়ার মিরপুর পৌরসভা, রাজশাহীর তানোরের মুণ্ডমালা পৌরসভা, মাদারীপুরের কালকিনি পৌরসভা, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা পৌরসভা, লক্ষ্মীপুরের রামগতি পৌরসভা নির্বাচনসহ আরো অনেক স্থানেই সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মারা, আগের রাতেই ভোট দিয়ে ফেলার অভিযোগসহ ভোট না দিলে রাতে ঘুমাতে না দেওয়ার হুমকি, ভোট না দিতে ঘর থেকে বের না হওয়ার হুমকিসহ আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে। সরকারদলীয় নেতাদের এমন ভোট চুরি করার কৌশল আর ভোট না দিলে হুমকি দেওয়ার ফলে দেশে নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১১
আপনার মতামত জানানঃ