কবির হোসেন : ‘বইমেলা’ শব্দটা মগজে উচ্চারিত হলে আমাদের মনে কখনো ভাসে না সন্ত্রাস, খুনি, প্রতারক, রাজনীতিবিদ, চতুর ধান্দাবাজ, অপরাধী ইত্যাদি। আমাদের মনে ভাসে কবি লেখক সাহিত্যিক প্রকাশক এবং অবধারিতভাবে বইপ্রেমী পাঠক। মহৎ যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ক্ষুদ্র পরিসরের এই বইমেলার আজ বৃহৎ পরিসরের দিকে ক্রমাগত উন্নয়নমান, পরিসরের ক্রমাগত বিস্তৃতি ঘটা অব্যাহত থাকলেও ওই মহৎ উদ্দেশ্যটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে গোড়াতেই। ক্ষুদ্রের পরিসর-বিস্তৃতিই যে উন্নয়ন নয়, বইমেলা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে তাই দেখিয়ে দিচ্ছে।
এবারের বইমেলা শুরু থেকেই করোনা নামের এক বিশাল ঝড়ের তোপে বিধ্বস্ত। বইমেলা হবে কি হবে না, হলেও কীভাবে হবে এনিয়ে চলছিল বিস্তর টানাপোড়েন। এসব টানাপোড়েন শেষেও যখন বইমেলা শুরু হলো তখন করোনার ওই ঝড়ে বইমেলা তার পুরনো নির্দিষ্ট সময়ের পরেই আয়োজিত হয়েছে। অর্থাৎ, করোনা নামের ঝড় বইমেলাকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দিয়েছে। বইমেলা এখন বিলম্বিত বইমেলা হিসাবেই পরিচিত হচ্ছে। অর্থাৎ, বোঝা যাচ্ছে করোনা আর বইমেলার শত্রুতা শুরু থেকেই। আর এই শত্রুতার জেরেই বইমেলা এখন করোনার বিপরীত চরিত্রে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি অবস্থানে।
করোনা আমাদের জন্য অভিশাপ নাকি আশির্বাদ এনিয়ে শুরু থেকেই বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে উভয় দিকেই জোরালো কিছু লক্ষণীয় প্রমাণও আমাদের সামনে উপস্থিত আছে। তবে বিশেষ করে ভাবুক শ্রেণিরা করোনাকে আশির্বাদ হিসাবেই ভেবে স্বাচ্ছন্দ্য নিচ্ছেন। পৃথিবী ও প্রকৃতির ওপর যুগ যুগ ধরে আমরা যে অত্যাচার-নির্যাতন করে আসছি, করোনা যেন পৃথিবীর পক্ষ নিয়ে তাকে উদ্ধারের ত্রাণকর্তা হিসাবেই আমাদের বিপরীতে উদ্ভব হয়েছে। পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষায় করোনা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে বলেই ভাবুক শ্রেণির মত।
এখন মূল প্রসঙ্গে আসার আগে এই ‘ভারসাম্য’ শব্দটার দিকে কিছুটা নজর দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। ভারসাম্য শব্দটার সাথে অবধারিতভাবেই বৈষম্য শব্দটা জড়িয়ে আছে। বৈষম্য না থাকলে ভারসাম্য শব্দটাও তার অস্তিত্ব হারায়। এখন করোনার চরিত্র বিশ্লেষণ করে আমরা দেখতে পারি যে, এই ভারসাম্য রক্ষায় করোনা কোথায় কোথায় কাজ করছে। পৃথিবীতে নানাবিধ দূষণ, অত্যাচার, প্রকৃতির একতরফাভাবে বিকৃত দিকে পথযাত্রা রুখে দেওয়াসহ আমাদের প্রসঙ্গের সাথে যুতসই আরেকটি বিষয় হলো ব্যক্তি বা শ্রেণির বৈষম্য বা ভারসাম্যহীনতা।
করোনার বিষদাঁত নিয়ে রাজধানী শহর যতটা আতঙ্কিত গ্রামাঞ্চল তার ধারে কাছেও নেই। গ্রামের লোকদের এখনো বিশ্বাস করানো কঠিন যে পৃথিবীতে করোনা নামের এক ভয়াবহ মহামারি চলছে। গ্রামাঞ্চলের লোকজন করোনার ভয়ানকতম সময়গুলোতেও যেমন নির্ভার ছিল, এতে করোনার অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন জেগে ওঠে। এদিকে করোনাও যেন গ্রামাঞ্চলের লোকজনদের নিকট নিজেকে তেমনভাবে উপস্থাপন করছে না।
রাজধানী শহরেও করোনার এই বৈষম্য লক্ষণীয়। ঢাকায় বসবাসরত খেঁটে খাওয়া বস্তিবাসীর নিকটও করোনা কোনো এক কারণে যেন নিজেকে চেনাচ্ছে না। করোনায় যারা আক্রান্ত হচ্ছে, এখানেও বিশেষ এক বৈষম্য দেখা যায়। কয়েকটা পরিসংখ্যানেও দেখা যায়, করোনা বস্তিবাসীদের ছেড়ে ভবনবাসীদের পিছনেই উঠেপড়ে লেগেছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা হার্ড ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার নিক্তিতে এই বৈষম্য ঘুচাতে নিজেদের গবেষণালব্ধ মন্তব্য রেখেছেন। এখন গোটা পৃথিবীকে যদি একটি বাংলাদেশ ভাবি, আর ইউরোপ আমেরিকাকে যদি রাজধানী ঢাকা এবং বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোকে যদি গ্রামাঞ্চল কিংবা বস্তি ভাবি, একই চিত্র দেখা যায়। করোনা যেন সিদ্ধান্ত নিয়েই ইউরোপ আমেরিকার পিছনে লেগেছে, আক্রান্তের দিক থেকে এমনিই বিচার আসে। অর্থাৎ, করোনা বৈষম্য দূর করতে কিংবা ভারসাম্য রক্ষা করতে এসে নিজেই বৈষম্য করে যাচ্ছে। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই,পৃথিবী কিংবা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় করোনা ধর্মাবতারের ভূমিকা গ্রহণ করে কাজ করে যাচ্ছে।
এখন মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। করোনা আর বইমেলার শত্রুতা, বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়ে। করোনা বইমেলাকে তার নির্দিষ্ট সময়ে হওয়ার পথে বাধা দিয়েছে, করোনার সাথে যেন বইমেলার এই জেরে শত্রুতা। তাই বইমেলায় তার বৈষম্যমূলক আচরণ স্পষ্ট ও লক্ষণীয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল পরিসরে বইমেলা নিজেকে বিস্তৃত করেছে বটে, তবে বইমেলার প্রাণকেন্দ্র কিংবা রাজধানী বলে বিবেচিত যে স্থান, চুম্বক অংশটুকু, সেখানে প্রভাবশালী বই ব্যবসায়ীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। অর্থাৎ যতগুলো প্যাভিলিয়ন আছে তাদের অবস্থান বইমেলার কেন্দ্র বলে বিবেচিত স্থানে অবস্থিত। একইসাথে, এমনভাবে প্যাভিলিয়নগুলোকে বইমেলা কর্তৃপক্ষ সুবিধা দিয়েছে, ড্রোন ক্যামেরায় দেখলে বোঝা যাবে এই প্যাভিলিয়নদের জন্যই যেন বইমেলার আয়োজন। বাকিরা পার্শ্বচরিত্র হিসাবে নিজেদের ভূমিকা পালন করছে।
উদ্যানের আলোকস্তম্বের দুই পাশে চিপা গলির মতো যে জায়গা রয়েছে, সেখানে ছোট প্রকাশনিদের পসরা বসানো হয়েছে। ছোটদের বইয়ের জন্য খ্যাত প্রকাশনিগুলোকে আগের মতোই একদিকে ঠেলে রাখা হয়েছে। আর আমাদের বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে আসা লিটলম্যাগগুলোকে এমনিভাবে সংকুচিত করে স্থান দেওয়া হয়েছে যেন তাদের দেওয়াটা বড় কোনো দান-খয়রাত হয়ে গেছে। না দিলেও চলে তবুও দিয়েছি, এইতো অনেক, এমনি বিচার দেখা গেলো লিটলম্যাগগুলোতে। বইমেলার একেবারে প্রান্তে, প্রবেশ পথে বাঁশ দিয়ে যেমন সারি করে রাখা হয় তেমনি সারি করে, পাবলিক বাসের ঠেলাঠেলি করে কোনো রকম গাঁ বাঁচিয়ে ঝুলে থাকা যাত্রীর মতোই লিটলম্যাগের অবস্থান। লিটলম্যাগগুলোর অবস্থা খুবই করুন, অসহায়, দেখলেই ইচ্ছে করে দুই-চার টাকা খয়রাত দিয়ে তাদের সাহায্য করি। আর প্যাভিলনগুলোকে দেওয়া হয়েছে আলিশান ফ্ল্যাট, বিশাল বারান্দা, বাগান করা উঠোন, গুলশানের রিক্সাবিরোধী ভিআইপি পরিবেশ ইত্যাদি।
অনেকটা বাংলা সিনেমার মতোই। আর বইমেলা কর্তৃপক্ষকে মনে হলো বাংলা সিনেমার পরিচালক। যারা কেন্দ্রীয় চরিত্রটিকে গ্লোরিফাই করে থাকে, অন্যান্য চরিত্রগুলো বিরক্তি নিয়েই যেন চরিত্রায়ন করে। তবুও কী করা, পার্শ্বচরিত্র ছাড়া তো কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্লোরিফাই হয় না, তাই রাখা। অর্থাৎ, প্যাভিলন ছাড়া অন্যস্টলগুলো হলো বলির পাঁঠা।
এখন অনেকে বলতে পারে, বইমেলায় স্টল বরাদ্দ তো লটারির মাধ্যমে হয়েছে। লটারির মাধ্যমে হলে তো বৈষম্যের কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়! লটারিতে যে যেখানটা পেয়েছে সেখানেই আসন গেড়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্নটা হলো, এতো সুশৃঙ্খল বৈষম্য লটারির মাধ্যমে কীভাবে সম্ভব? সামগ্রিক অবস্থান দেখলেই বুঝে যাওয়ার কথা এটা লটারির মাধ্যমে হয়েছে নাকি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ কিংবা নিয়ন্ত্রণে হয়েছে। এমন সুশৃঙ্খলভাবে বৈষম্য কেবল কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণেই সম্ভব, লটারিতে এতো বড় কাকতাল মোটেও সম্ভব নয়। দেখলেই বোঝা যায়, তালগাছ পকেটে পুরেই বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এরকমই এক চিত্র দেখা গেল গতরাত বইমেলা শেষে। শাহবাগ মোড়ে জায়গায় জায়গায় লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সময় তখন আট কি সাড়ে আট। এই ভিড়ে আছে বইমেলা ফেরত কবি সাহিত্যিক, চাকরি শেষে বাসার দিকে যাত্রা করা চাকরিজীবী ও অন্যান্য সাধারণ মানুষ। উদ্দেশ্য, বাস এলে বাস ধরে বাসায় ফিরবে। কিন্তু বাস আসছে না। এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা যায়, কোনো বাস আসে না। সকলের চোখেমুখেই বিরক্তির ছাপ। অপেক্ষা করতে করতে নেতিয়ে পড়েছে সকলে। তবুও বাস আসার লক্ষণ নেই। ঘটনা কী? জানা গেল শেষে, মিয়ানমারের রাষ্ট্র প্রধান বাংলাদেশে, তাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বের হবেন, এমনি কিছু। উপায়ন্তর না দেখে, এই লেখার লেখক কয়েকজন কবি সাহিত্যিকের সাথে পায়ের ওপর ভরসা করে হাঁটা ধরেন মিরপুরের উদ্দেশ্যে। শাহবাগ থেকে মিরপুর, দীর্ঘ পথ, তবুও উপায় নেই।
সাকুরা মোড়ে এসে দেখা গেল পুলিশের প্রহরা। এই রোডেই বিদেশি অতিথিসহ ভিআইপিরা আসবেন। রোডঘাট একদম পরিষ্কার, কোনো ধুলাবালি নেই। ধুলাবালির সাথে মানুষও নেই।
বিদেশি অতিথিসহ ভিআইপিরা বের হতে দেরি করছেন। তাই আমরা কয়েকজন ফুটপাত ধরে দ্রুত হাঁটা ধরি ফার্মগেইটের দিকে। কিছুটা সামনে দেখি এক পুলিশ আমাদের মতোই দ্রুত হেঁটে যাচ্ছেন। দৌড়ে গিয়ে ধরি। তিনি জানান, তিনি বইমেলায় ডিউটি শেষে বাসায় ফিরছেন। বাস নেই, এপথে ভিআইপিরা আসবেন, তাদের আগেই রাস্তা পরিষ্কার করতে হবে। তাই দ্রুত হাঁটা।
চারদিকে দেখি সিনেমার পার্শ্বচরিত্রগুলো তটস্থ হয়ে আছে, যেহেতু সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রের এখনি এন্ট্রি হবে।
পরিশেষ: বইমেলা হলো কবি-সাহিত্যিকদের মিলনস্থল, এ পুরনো কথা। পুরনো কথা নতুন করে বলা হলো এই জন্য যে, বইমেলার আয়োজন নিয়ে যে নষ্ট চিত্রের উপস্থাপন করা হলো, এর দায়ভার কবি-সাহিত্যিকদের ঘাড়েই পড়ে। কেননা, বইমেলার চৌহদ্দি জুড়ে সাহিত্যিকদের পদচারণার পাশাপাশি কর্তৃত্বও রয়েছে। তাই বইমেলার আয়োজনে যে বৈষম্য ও নষ্টামি, তা সাহিত্যিকদেরই নষ্টামির চূড়ান্তরুপ। আর সাহিত্যিকরা নষ্ট হয়ে গেলে রাষ্ট্রের কী হয়, তা বলেই এই লেখার সমাপ্তি টানতে যাচ্ছি।
কবি সাহিত্যিকরা হলো একটি জাতি, দেশ ও রাষ্ট্রের সেন্টার, বিবেক কিংবা ব্রেন। এখানে গোলাপ বাগান বপিত হলে গোটা দেশেই এর সুঘ্রাণ পৌঁছে যাবে বিদ্যুতের মতোই। এখানে গোবর বপিত হলে দুর্গন্ধও ছড়াবে একইভাবে। রাষ্ট্রের ব্রেন বলে বিবেচিত এই সাহিত্যিকরা নষ্ট হয়ে গেলে এর কুফল গোটা রাষ্ট্রেই ছড়িয়ে পড়বে। একজন মানুষের ব্রেন যদি নষ্ট হয়ে যায় তবে তাকে যেমন পাগল বলা হয়, তেমনি রাষ্ট্রের ব্রেন কবি সাহিত্যিকরা নষ্ট হয়ে গেলে রাষ্ট্রও পাগল হয়ে যায়। আমাদের রাষ্ট্রের দিকে খেয়াল করলে এই পাগলামিটাই কি দেখতে পাই না?
এই লেখার শিরোনাম ‘বইমেলা, নষ্ট রাষ্ট্রের এক অনন্য প্রতিচ্ছবি’ না হয়ে ‘রাষ্ট্র, নষ্ট কবি-সাহিত্যিকদের এক অনন্য প্রতিচ্ছবি’ও যুক্তিযুক্ত।
আপনার মতামত জানানঃ