জমে উঠছে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন। তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির হাড্ডাহাড্ডি লড়াই জমতে যাচ্ছে বলেই নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের আগাম ধারণা। ইতিমধ্যে দুই দলের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে গরম হয়ে উঠেছে নির্বাচনী মাঠ। গতকাল বৃহস্পতিবার(১৮ মার্চ) এক নির্বাচনী প্রচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লি থেকে বিজেপি নেতা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তাড়ানোর হুমকি দিয়েছে। অপরদিকে মোদিও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। সেও মমতাকে বাংলা ছাড় করার হুমকি দিয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ায় এক জনসভায় অংশ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলায় মমতার খেলা শেষ করে দেবে বলে এ হুমকি দেয়।
মমতার হুমকি
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, বাংলার নির্বাচনে জয়ের পর বিজেপিকে দিল্লি থেকেও বিতাড়িত করা হবে। বিধানসভার ভোটের পর দিল্লিতে ঝাঁপিয়ে পড়ব।
বৃহস্পতিবার জঙ্গলমহলে নির্বাচনী প্রচারে মমতা বলেন, দুর্যোগের সময় বিজেপি নেতাদের দেখা মেলে না। ভোটের সময় টাকার বাপ নিয়ে হাজির হন তারা। বিজেপি নেতারা লুটেরা।
বৃহস্পতিবার পশ্চিম মেদিনীপুরের আরও তিন জায়গায় নির্বাচনী সভা করেন মমতা। গড়বেতার সভায় তিনি বলেন, ‘বিজেপি একটা সর্বনাশা দল। বাইরে থেকে ট্রেন-বাসে লোক ভাড়া করে এনে ভয় দেখাচ্ছে। ভয় দেখাতে এলে রুখে দাঁড়াবেন আপনারা।’
সিপিএমের লোকজনই এখন বিজেপিতে গিয়ে ভিড়েছে বলে অভিযোগ করেন মমতা। তিনি বলেন, ‘সিপিএমের হার্মাদগুলো বিজেপিতে গেছে। জঞ্জালের পার্টি বিজেপি। সুশান্ত ঘোষকে সবাই চেনে। এই অসাধুদের রুখতে হলে তৃণমূলকে ভোট দেবেন।’
মমতা আরও বলেন, ভারতের অনেক রাজ্য জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জির (এনপিআর) কাজ শুরু করেছে। বাংলায় তা করতে দিইনি আমরা। আমি যখন লডাই করি, বাঘের বাচ্চার মতো লড়াই করি। বিজেপি ভোটে টাকা ছড়াচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ভোট এলেই ক্যাশ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বিজেপি। হাজার হাজার নেতা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাইরে থেকে বিমানের পর বিমানে চেপে আসছেন। আপনাদের কাছে এলেই হাতে খুন্তি নিয়ে তেড়ে যাবেন।
মোদির হুমকি
এদিন পুরুলিয়ার জনসভায় মমতাকে আক্রমণ করে বক্তব্য দেন মোদি। এসময় তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রচারণার “খেলা হবে” স্লোগানের জবাবে “খেলা শেষ হবে”বলতে শোনা যায় স্বয়ং মোদিকে। এরমধ্য দিয়ে যেন অনেকটা প্রচ্ছন্ন হুমকিই দিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
বৃহস্পতিবার পুরুলিয়ায় বিজেপির নির্বাচনী জনসভায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, বাংলায় এবার দিদির খেলা শেষ হবে।
সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে ওই জনসভায় মোদি আরও বলেন, “বাংলার ভাইবোনেদের নিয়ে চিন্তার খেলা আপনি ১০ বছর খেলেছেন, এবার খেলা শেষ হবে, বিকাশ শুরু হবে। বাংলার মানুষের থেকে খেলার চিন্তা বেশি তৃণমূলের। দিদি ভুলে যাচ্ছেন, বাংলার জনতা বিরোধিতায় তৈরি। ১০ বছর ধরে বিশ্বাসঘাতকতা, দুর্নীতির এবার শেষ হবে বিধানসভা ভোটে। আপনি খেলতে থাকুন, বাংলার মানুষের স্মৃতিশক্তি খুব জোর। গাড়ি থেকে বেরিয়ে কীভাবে লোককে ধমকেছেন সবার সব মনে আছে।”
তিনি আরও বলেন, “দিদি বলে খেলা হবে, বিজেপি বলে বিকাশ হবে। দিদি বলে খেলা হবে, বিজেপি বলে শিক্ষা হবে। দিদি বলে খেলা হবে, বিজেপি বলে সোনার বাংলা হবে। দিদি বলে খেলা হবে, বিজেপি বলে প্রত্যেক ঘরে জলের কল হবে, পরিষ্কার জল হবে। দিদি বলে খেলা হবে, বিজেপি বলে চাকরি হবে। দিদি বলে খেলা হবে, বিজেপি বলে গ্রামে গ্রামে জনসুবিধা হবে। দিদি বলে খেলা হবে, বিজেপি বলে হাসপাতাল হবে। দিদি বলে খেলা হবে, বিজেপি বলে স্কুল হবে।”
নরেন্দ্র মোদি আরও বলেন, ‘বাংলা থেকে দিদি বিদায় নিচ্ছে। বাংলায় আসল পরিবর্তন আসছে। এবার ভয় নয়, শুধু জয়। পশ্চিমবাংলাকে কুশাসন থেকে মুক্ত করার সময় আসছে। পশ্চিমবঙ্গের পুলিশকে অনুরোধ করব, আপনারা গণতন্ত্রের ওপর ভরসা রাখুন। এই বাংলায় তোলাবাজি, কাটমানি, সিন্ডিকেটের কোনো স্থান হবে না। অপরাধীরা জেলে যাবে। দিদির চালচোরেরা খেলা চালাতে থাকুক, কিন্ত আমরা চাইলেই খেলা শেষ হয়ে যাবে। বাংলায় চুরির খেলা আর চলবে না।’
তবে মোদির চেয়ে এককাঠি ওপরেই সুর চড়িয়েছেন মমতা। শুধু বিজেপিকে আক্রমণই নয়, গত ১০ বছরে তার সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন নিয়েও বক্তব্য দেন তিনি। মমতা বলেন, মাটির সৃষ্টি প্রকল্পে ২৫ হাজার একর অনুর্বর জমিকে উর্বর করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। আমি আপনাদের পাহারাদার, দুর্ঘটনা হলেও টাকা দিই।
তিনি বলেন, যারা বলে বাংলায় কিছু হয়নি, তাদের বলছি, বাংলায় ৪০ শতাংশ দারিদ্র্য কমেছে। আমরা ধ্বংসের বদলে ধ্বংস চাই না।
এবার নন্দীগ্রাম থেকে বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন মমতা। গত সপ্তাহে সেখানে নির্বাচনী প্রচার গিয়ে আহত হন। তারপর হুইলচেয়ারে বসেই জেলায় জেলায় প্রচার করছেন মমতা।
মমতার পায়ে চোট লাগা প্রসঙ্গে মোদি বলেন, ‘ভারতের কোটি কোটি নারীর মতোই দিদিও ভারতের একজন নারী। যাদের সম্মান করা আমাদের সংস্কারে আছে। এই জন্যই দিদির যখনই চোট লাগে তখনই চিন্তিত হই। আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, দিদি শিগগিরই সুস্থ হয়ে উঠুন।’
সমীক্ষা কী বলছে?
প্রধান দুই দলের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে নির্বাচনী মাঠ গরম হলেও বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও জরিপে মমতাই এগিয়ে আছে। বিভিন্ন সমীক্ষা আর জনমত জরিপে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের নিকট মমতা এখনো তুমুল জনপ্রিয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসেরই জয়ের সম্ভাবনা বেশি বলে জনসমীক্ষা সংস্থার (সিএনএক্স) তিন তিনটি রিপোর্ট জানিয়েছে।
‘ডাব্লিউবি ইলেকশন সি-ভোটার ওপিনিয়ন পল ২০২১ লাইভ’ নামে একটি জনমত সমীক্ষা করছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম এবিপি আনন্দ। এই সমীক্ষার তৃতীয় দফাও বলছে, এবারও ক্ষমতায় আসতে পারে তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে বেশি পছন্দের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই।
২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত এই জরিপে রাজ্যের ১৯ হাজার ৩১৪ জন ভোটার নিজেদের মতামত দেন। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, এবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ৫২ শতাংশ মানুষের পছন্দ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর ২৭ শতাংশ মানুষের পছন্দ রাজ্য বিজেপি প্রধান দিলীপ ঘোষ।
সমীক্ষা বলছে, বিধানসভা ভোটে তৃণমূল পেতে পারে ম্যাজিক ফিগার ১৪৮ অতিক্রম করে ১৫০ থেকে ১৬৬টি আসন। আর বিজেপি পেতে পারে ৯৮ থেকে ১১৪টি আসন।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায় রয়েছে ২৯৪টি আসন। রাজ্য সরকার গড়তে এখানে প্রয়োজন ১৪৮টি আসন। সেই হিসাবে বলা চলে, এবারের নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। ফলে বিপুল ভোটে জিততে পারবে না তৃণমূল বা বিজেপি কেউই। তবে জরিপের হিসাবমতে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃণমূলের জয়ের সম্ভাবনাই বেশি।
বিজেপি হাওয়া তুলেছে এবার তৃণমূলকে হারিয়ে প্রকৃত পরিবর্তন আনার। তৃণমূলকে ভেঙে ক্ষমতা খর্ব করেই তারা পসার লাভ করতে চাইছে। কিন্তু বিজেপির পক্ষে এভাবে তৃণমূলকে হারানো সম্ভব হবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিজেপি সেয়ানে সেয়ানে লড়ার মতো জায়গায় এলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছে, এবার বিজেপির অবস্থা ২০০১-এর তৃণমূলের মতো হবে। তৃণমূল যেমন সেবার হাওয়া তুলেও সিপিএমকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারেনি, এবার বিজেপিও পারবে না তৃণমূলকে হারাতে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৫
আপনার মতামত জানানঃ