দুপুরের প্রখর রোদে রাজধানীর কল্যাণপুর নতুন বাজারের পোড়া বস্তিতে ঢুকতেই চোখে পড়ল বৃদ্ধ মোশারফ হোসেন আনমনে বিড়বিড় করে কী যেন বলছিলেন। কাছে গিয়ে পরিচয় দিতেই বলে ওঠেন, ‘আগুনে আমার ঘর পুইড়া ছাই হইছে। তয় তার চাইতেও বড় কষ্ট আমার পোলার দোকান থাইকা টাহা-পয়সা লুট কইরা নিছে দুর্বৃত্তরা, ওরা তো মানুষ না, ওরা শকুন।’ এ সময় ছেলের নাম জানতে চাইলে আঙুলের ইশারায় বলেন, ‘ওই আমার পোলা মাহবুব।
তাঁর কাছ থেকে একটু সামনে এগিয়ে মাহবুবের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রতিদিনের মতো শুক্রবার রাতেও বস্তির পাশের সড়কে তিনি চটপটির দোকান দিয়েছিলেন। রাত ১০টার দিকে দোকান বন্ধের চিন্তা করছিলেন। এরই মধ্যে বস্তি লাগোয়া নান্নুর দোকান থেকে হঠাৎ বিকট শব্দ পান তিনি, চোখ ঘোরাতেই দেখেন আগুন। তিনি বলেন, ‘তহন আর কোনো কিছুর দিকে খেয়াল ছিল না আমার, জান লইয়া পালাই। পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর দেহি আমার দোকান পুড়ে নাই। তয়, দোকানের ভেতর একটি কৌটায় এক হাজার টাকার বেশি ছিল, সেইডাও লুট হইছে।’ এ সময় তার পাশেই মাথায় হাত দিয়ে বস্তির পাশে কান্না করছিল অনেকে। তাদের মধ্যে কারোর ঘর পুড়েছে, আবার কারো ঘর ও দোকান থেকে জমানো টাকা, টেলিভিশন, মোবাইল ফোনসেট এমনকি স্বর্ণালংকারও লুট হয়েছে। বস্তিতে আগুন লাগার সুযোগে কিছু দুর্বৃত্ত ঘর ও দোকানে ঢুকে সব লুট করে নিয়ে গেছে।
এদিকে গতকাল দুপুরে পোড়া বস্তিতে এসে মানুষকে সান্ত্বনা দিতে দেখা যায় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর রাজিয়া সুলতানা ইতিকে। তিনি বলেন, আগুনে অন্তত ৫০০ ঘর পুড়েছে। এর মধ্যে ২০ দোকান পোড়ার তথ্য পাওয়া গেছে। আবার আগুনের সময় অনেকের ঘর ও দোকান থেকে টাকা, মোবাইল ফোনসেট, টেলিভিশনসহ অনেক জিনিস লুট হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে আমি রাত থেকে বস্তিবাসীর পাশে রয়েছি। ক্ষতিগ্রস্তদের চালসহ খাদ্যদ্রব্যের পাশাপাশি শাড়ি-লুঙ্গিও দেওয়া হয়েছে। আগুনে অনেকে এক কাপড়ে ঘর ছেড়েছে।
এ সময় বস্তির সবুজ নামে একজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি দীর্ঘদিন ধরে বস্তির পাশে ফার্নিচারের ব্যবসা করেন। সামনে দোকান আর পেছনে ঘর বানিয়ে পরিবার নিয়ে তিনি থাকেন। আগুনের সময় মা, শিশুসন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে নিরাপদে সরে পড়েন। পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে দেখতে পান তাঁর ঘর খুব একটা পোড়েনি। তবে ঘর ও দোকানে রাখা কিছুই পাননি। তিনি দাবি করেন, ব্যবসার কাজে লাগাতে একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে দেড় লাখ টাকা তিনি ঘরেই রেখেছিলেন। এ ছাড়া ঘরে কিছু স্বর্ণালংকারও ছিল তাঁর। সেসব লুট হয়ে গেছে। এ সময় তাঁর পাশ থেকে জেসমিন নামের এক নারী বলে ওঠেন, আগুনে তাঁর ঘরের টেলিভিশন ও টাকা লুট হয়েছে।
যেভাবে আগুনের ঘটনা : গত শুক্রবার রাত ১০টার দিকে বস্তি লাগোয়া নান্নুর ভাঙ্গারি দোকানে চার শ্রমিক কাজ করছিলেন। এ সময় নান্নু নিজেও দোকানের পাশে ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শী মাহবুব বলেন, রাত ১০টার দিকে নান্নুর ভাঙ্গারি দোকানের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পরপরই আগুনের সূত্রপাত। এতে আগুন বস্তিতে ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে নান্নু প্রাণে বাঁচলেও তাঁর দুই কর্মচারী আগুনে দগ্ধ হন। তাঁরা হলেন আকতার হোসেন (১৯) ও মো. আনোয়ার (২১)। আনোয়ারের শরীরের ৭৫ শতাংশ ও আকতার হোসেনের ৪০ শতাংশ পুড়েছে। তাঁদের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন, তাঁদের দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তবে আগুনে কমবেশি ৪০ বস্তিবাসী দগ্ধ হয়েছে। এদের মধ্যে কমপক্ষে ১৫ শিশু কিছুটা দগ্ধ হয়েছে। গতকাল দুপুরে এসব শিশুকে দেখা যায় বস্তির পাশেই মা-বাবার সঙ্গে। এ সময় শিশু জিহাদুরের পা, খুশির হাত ও চুল এবং কহিনুরের হাত-পা পুড়েছে বলে তাদের অভিভাবকরা জানান। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, রাতে আগুনের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে রাত ১১টা ১০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক সালেহ উদ্দিন জানান, ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে আগুন লাগার কারণ জানা যাবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আ স ম মাহাতাব উদ্দিন বলেন, ‘ আগ্নিকাণ্ডের সময় বস্তিবাসীর মালামাল লুট হয়ে থাকলে তারা থানায় অভিযোগ দিতে পারে। এরপর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৮ সালে গড়ে ওঠা কল্যাণপুর নতুন বাজার বস্তির ৭ নম্বর সেকশন এলাকায় প্রায় দুই হাজার মানুষের বাস। এর আগেও এই বস্তিতে ১০-১২ বার আগুন লেগেছিল।
সোর্স : কালের কন্ঠ, পৃষ্ঠা ১৬ / ০১ নভেম্বর ২০২০
আপনার মতামত জানানঃ