কমনওয়েলথ মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড কিউসি ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উপলক্ষে তার এক বিবৃতিতে, কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর জন্য অনুপ্রেরণাদায়ী নারী নেতাদের তালিকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম উল্লেখ করেন এবং তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। এদিকে, এই বিবৃতির কড়া সমালোচনা করেন সংস্থাটির এশিয়ার কার্যনির্বাহী পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডাম এবং যুক্তরাজ্যের পরিচালক ইয়াসমিন আহমেদ।
গত ১২ মার্চ কমনওয়েলথ মহাসচিব বরাবর তারা এ বিষয়ে লিখিত বিবৃতিও প্রদান করেন। তারা লেখেন, সম্প্রতি সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পর্কে আপনার প্রশংসাসূচক মন্তব্যে আমরা উদ্বিগ্ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশটিতে ক্রমবর্ধমান স্বৈরতন্ত্রে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে আসছেন এবং অনেকাংশেই সেখানে সংসদীয় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন যেখানে রাষ্ট্রপক্ষ বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম এবং নির্যাতন চালাচ্ছে দেশটিতে। গণমাধ্যমে সরকারের সমালোচকদের প্রাণনাশের হুমকি ও গ্রেফতার করা হচ্ছে। নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে এবং ব্যহত হচ্ছে বিরোধীদলগুলোর শান্তিপূর্ণ কার্যক্রম।
গত ৫ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আপনার বিবৃতি আমাদের বিস্মিত করেছে। আপনি বলেছেন, ‘আমি কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তিন জন বিস্ময়কর নারী নেতৃত্বের কথা উল্লেখ করতে চাই, যারা কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা হলেন— নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন, বার্বাডোসের প্রধানমন্ত্রী মিয়া আমোর মোটলি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’ আপনি টুইটও করেছেন এ বিষয়ে। যে নারীরা আপনাকে অনুপ্রাণিত করে তাদের নাম উল্লেখ করে আপনি #SheLeadsTheWay ক্যাম্পেইনে যোগ দিতে সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এই নামগুলোর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামও ছিল।
আপনার প্রশংসাসূচক বিবৃতির কিছুদিন আগে দেশটিতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ভিন্নমতাবলম্বী লেখক মুশতাক আহমেদ কারাগারে মারা যান। মে মাসে করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের আরও স্বাস্থ্য উপকরণ প্রয়োজন বিষয়ে মুশতাকের ফেসবুক পোস্টের জের ধরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে নয় মাস জেলে আটকে নির্যাতন করা হয়। মুশতাকের মৃত্যুর পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে কার্টুনিস্ট কবির কিশোর জামিন পান। কিশোর জানান, তাকে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়েছে কারাগারে এবং মুশতাককে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছিল।
বাংলাদেশ সরকার কোভিড-১৯ এর জন্য গৃহীত ব্যবস্থা প্রকারন্তরে গণমাধ্যম এবং মানুষের মতপ্রকাশের অধিকারকে সংকুচিত করেছে। শিল্পী, শিক্ষার্থী, ডাক্তার, বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মহামারি প্রতিরোধে সরাকারি পদক্ষেপের সমালোচনার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে।
২০০৭-০৮ সালে যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শেখ হাসিনাকে অবৈধভাবে আটক করে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো তখন তার এবং অন্যান্য রাজনৈতিককর্মীদের অধিকার আদায়ে ও ভোগান্তির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল। শেখ হাসিনা অঙ্গিকার করেছিলেন, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা তার প্রধান দায়িত্ব হবে। নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করবেন। যদিও গণমাধ্যম এবং সকল প্রকার সরকার বিরোধী সমালোচনার মুখ বন্ধ করতে তিনি বেছে নিয়েছেন বিচারবহির্ভূত হত্যার পথ। আর এই পথে তিনি ব্যবহার করছেন র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণের পর থেকে র্যাব, বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনী, পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে দেশ জুড়ে চলছে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতন।
এমনকি বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা জোরপূর্বক অপহরণের জোরালো প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার তা বিনা তদন্তে অস্বীকার করেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা এতোটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে, সংসদে দাঁড়িয়ে মন্ত্রীরা একে ‘ক্রসফায়ার’ দাবি করেছেন। বিস্মিত হবার কিছু নেই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর রাজনীতিকরণ করেছেন। দলটির অনুগতদের প্রধান পদগুলোতে বসিয়ে, তাদের থেকে সুবিধা আদায় করছে দলটি। আল-জাজিরার ডকুমেন্টারি ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’-এ এমনটাই দেখান হয়েছে।
২০১৮ সালের নির্বাচন স্বৈরাচারী শাসনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট ৯৬ শতাংশ আসনে জয় লাভ করে। তবে এই জয়ের নেপথ্যে ছিল কারচুপি, বিরোধী দলগুলোর উপর ভয়াবহ চাপ প্রয়োগ, গ্রেফতার ও হয়রানি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্র সবাই নির্বাচনী এই অরাজকতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। এরপরই আওয়ামী লীগ সরকার দেশটিতে স্বৈরাচারী শাসনের শেকড় গেঁথে দিয়েছে। দেশটিতে এখন কোন প্রভাবশালী বিরোধদল নেই। এদিকে, ২০১৮ সালে প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রায় দুইশ’ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মত প্রকাশের এবং সরকারি যেকোন পদক্ষেপের সমালোচনার সুযোগ নেই দেশেটিতে। গত বছর, ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করায় এক শিশুকে গ্রেফতার করা হয়। যার দ্বারা সরকার এটি স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছে, সরকারের জন্য অস্বস্তিকর এমন যেকোন মতামত প্রকাশ ‘এন্টি-গভমেন্ট প্রপোগান্ডা’ এবং এসব কিছু সরকারের তরফ থেকে কড়া নজরদারিতে রাখা হচ্ছে।
এমনি মানবাধিকার সংস্থার দাবি, দেশটি নারীদের নিরাপত্তা দিতেও ব্যর্থ হয়েছে সম্পূর্ণভাবে। যৌন নিপীড়ন এবং নির্যাতন দেশটিতে এখন এক ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটির ৭০ শতাংশ নারী কোনও না কোনও ভাবে নির্যাতনের শিকায় হচ্ছে। তথাপি মাত্র ৩ শতাংশ নারী আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। অঙ্গিকার সত্ত্বেও যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণ প্রতিরোধে কার্যকরী আইন প্রণয়নে ও প্রয়োগে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। সম্প্রতি বেশ কিছু গণধর্ষণের ঘটনা সামনে আসলে, সাধারণ মানুষ ধর্ষণ প্রতিরোধে সরকারের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ হয়ে নতুন আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করলে তাড়াহুড়ো করে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা দেয় দেশটির সরকার।
কমনওয়েলথের সনদ অনুযায়ী, সদস্য রাষ্ট্রগুলো সংস্থাটির মূল নীতিমালা মেনে চলতে বাধ্য থাকবে যার মধ্যে আছে মানবাধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, আইনের শাসন এবং নাগরিক সমাজ ব্যবস্থা। কমনওয়েলথ ওয়েবসাইটে উল্লেখ আছে, ‘দ্য কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েট একটি আন্তঃসরকারি সংস্থা যা তার সদস্য দেশগুলোকে গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কমনওয়েলথের যে উদ্দেশ্য তা অর্জনে সাহায্য করে।’ পাশাপাশি ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারকে উৎসাহিত করে। জনকল্যাণমুখী আইন প্রণয়ন এবং শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
আমরা বুঝতে পারছি না, কোন মাপকাঠিতে আপনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নেতৃত্বের জন্য সাধুবাদ জানালেন এবং অনুপ্রেরণাদায়ী নারী হিসেবে আখ্যা দিলেন। আপনি নিশ্চয় জানেন, শেখ হাসিনার মতো নেত্রীকে এই ধরণে মূল্যায়ন দেশটির অভ্যন্তরীণ স্বৈরতন্ত্রকে বৈধতা দান করবে। বিরোধী মতকে তোষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাবে উদ্বেগজনক হারে।
এটিই কমনওয়েলথ এবং অন্যান্যদের জন্য উপযুক্ত সময় বাংলাদেশি নাগরিক সমাজ, স্বাধীন গণমাধ্যম এবং যারা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছেন তাদের পাশে দাঁড়ানোর। দেশটিতে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম বন্ধ করতে, মত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রদ এবং সাংবাদিক, সমালোচক এবং রাজনৈতিক কর্মীদের মুক্তি দিতে কমনওয়েলথের উচিত প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানানো। আমরা আশা করি, আপনি আপনার মন্তব্য পুনর্বিবেচনা করবেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬০০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ