করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে কঠোর হচ্ছে সরকার। জনসাধারণকে মাস্ক পরাসহ সচেতনতা বাড়াতে সারাদেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।
স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান বলেন, মাস্ক ব্যবহারে এখন ঢিলেঢালা ভাব এসে গেছে৷ অন্যদিকে করোনা সংক্রমণ আবার বেড়েছে৷ এই প্রেক্ষাপটে মাস্ক ব্যবহারে আগের নির্দেশনাগুলোই কঠোরভাবে পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ তিনি জানান, মঙ্গলবার (১৬মার্চ) থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত নামানো হয়েছে৷ দেশের সব জেলায়ই ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলবে৷ তারা জরিমানাও করবেন৷
ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ভাস্কর দেবনাথ বাপ্পি জানান, মঙ্গলবার থেকেই ভ্রাম্যমাণ আদালত নেমেছে ঢাকায়৷ ঢাকা শহর এবং ঢাকা জেলার পাঁচটি উপজেলায় ১৫ জন ম্যাজিষ্ট্রেট ১৫টি ভ্রাম্যামাণ আদালত পরিচালনা করেছেন৷ তারা ১৬৬ টি মামলা করেছেন৷ ২৬ হাজার ১০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে৷ বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে এক হাজার ২০০৷
জেলা প্রশাসকদের ১১ দফা নির্দেশনা জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে৷ এই নির্দেশনার মধ্যে আছে-
১. সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিসে কর্মরত কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট অফিসে আগত সেবা গ্রহীতাগণ বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহার করবেন। সংশ্লিষ্ট অফিস কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
২. সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালসহ সকল স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে আগত সেবা গ্রহীতাগণ আবশ্যিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করবেন। সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির ও গির্জাসহ সকল ধর্মীয় উপাসনালয়ে মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট পরিচালনা কমিটি বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
৪. শপিংমল, বিপণিবিতান ও দোকানের ক্রেতা-বিক্রেতাগণ আবশ্যিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করবেন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও মার্কেট ব্যবস্থাপনা কমিটি বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
৫. হাট-বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতাগণ মাস্ক ব্যবহার করবেন। মাস্ক পরিধান ব্যতীত ক্রেতা-বিক্রেতাগণ কোনো পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করবেন না। স্থানীয় প্রশাসন ও হাট-বাজার কমিটি বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
৬. গণপরিবহনের (সড়ক, নৌ, রেল, আকাশপথ) চালক, চালকের সহকারী ও যাত্রীদের মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। গণপরিবহনে আরোহণের পূর্বে যাত্রীদের মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মালিক সমিতি বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
৭. গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিসহ সকল শিল্প কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও মালিকগণ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
৮. হকার, রিক্সা ও ভ্যানচালকসহ সকল পথচারীর মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিষয়টি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিশ্চিত করবেন।
৯. হোটেল ও রেস্টুরেন্টে কর্মরত ব্যক্তি এবং জনসমাবেশ চলাকালীন আবশ্যিকভাবে মাস্ক পরিধান করবেন। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট মালিক সমিতি নিশ্চিত করবেন।
১০. সকল প্রকার সামাজিক অনুষ্ঠানে আগত ব্যক্তিদের মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করতে হবে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধান নিশ্চিত করবেন।
১১. বাড়িতে করোনা উপসর্গসহ কোনো রোগী থাকলে পরিবারের সুস্থ সদস্যগণ মাস্ক ব্যবহার করবেন।
এই নির্দেশগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে৷ আর জেলা প্রশাসকদের সার্বিকভাবে মনিটরিং করতে বলা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য সচিব জানান৷
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কঠোর হওয়ার কোনো বিকল্প সরকারের কাছে ছিল না। সংক্রমণ বাড়তে থাকায় মানুষকে মাস্ক ব্যবহারসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বারবার অনুরোধ করে আসছিলাম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ সেই অনুরোধে সাড়া দেননি। সুতরাং কঠোর হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। মানুষ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, তা নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। মাস্ক না পরলে, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে আগের মতো জরিমানা করা হবে। আগের মতো কঠোর হচ্ছে সরকার এবং এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
এর আগে গত নভেম্বরে জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন এবং বিআরটিএ মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে সড়কে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে৷ মাস্ক ব্যবহার না করলে জরিমানা করা হয় এবং তাদের মধ্যে মাস্ক বিতরণ করা হয়৷ কিন্তু এক মাসের বেশি এই কার্যক্রম চলেনি৷ তখন প্রধানমন্ত্রী নিজে ঘোষণা করেন, ‘‘নো মাস্ক নো সার্ভিস৷’’
কিন্তু ডিসেম্বরের পর থেকে করোনা সংক্রমণ কমে আসায় সরকারের কড়াকড়িও উঠে যায়৷ সাধারণ মানুষও মাস্ক ব্যবহারে অনীহা দেখায়৷ আর সামাজিক দূরত্বের বিষয়টিও উধাও হয়ে যায়৷ এখন গণপরিবহণে যাত্রীরা তেমন মাস্ক পরেন না৷ বাজার হাট বা জনসমাগমস্থলে মানুষ ইচ্ছেমত ভিড় করেন মাস্ক ছাড়াই৷ সভা-সমাবেশেও একই অবস্থা৷
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্যাহ বলেন, ‘‘করোনার সংক্রমণ কমে আসায় যাত্রীরা এখন আর মাস্ক পরতে চায় না৷ পরিবহণ শ্রমিকদের মধ্যেও অনীহা৷ আমরা মাস্কের কথা বললে তারা বিরক্ত হয়৷’’
তিনি বলেন, আবার গণপরিবহণে মাস্কের ব্যাপারে সরকারের আদেশ মেনে আমরা কঠোর হচ্ছি৷ বিআরটিএ মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ আমরা তাদের সহায়তা করব৷
এদিকে দেশে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের নতুন স্ট্রেইন পাওয়া গেছে। এ তথ্য জানিয়েছে গ্লোবাল জিনোম সিকোয়েন্সিং ডেটাবেস জিআইএসএআইডি। এর আগে জানুয়ারিতে কয়েকজনের দেহে যুক্তরাজ্যের নতুন স্ট্রেইন পাওয়া যায়।
“বাংলাদেশে করোনার ১২টি স্ট্রেইন রয়েছে, যা একাধিক দেশেও পাওয়া গেছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের স্ট্রেইনগুলো সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের বিষয়।”
করোনার ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত আছে৷ মঙ্গলবার গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে করোনায় ২৬ জন মারা গেছেন৷ নতুন করে এক হাজার ৭১৯ জন সংক্রমিত হয়েছেন৷ সোমবারও ২৬ জনের মৃত্যু এবং এক হাজার ৭৭৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন৷ গত ১ মার্চ করোনায় মারা যান আট জন৷ আর আক্রান্ত হন ৫৮৫ জন৷ দুই সপ্তাহে সংক্রমণ বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি আর মৃত্যু তিন গুণের বেশি৷ৎ
বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী পাওয়া যায় গত বছরের ১৮ মার্চ৷ এপর্যন্ত পাঁচ লাখ ৬০ হাজার ৮৮৭ করোনা আক্রান্ত সনাক্ত হয়েছে৷ মারা গেছেন আট হাজার ৫৯৭ জন৷ ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশে টিকা দেয়া শুরু হয়৷
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১২০৯
আপনার মতামত জানানঃ