ফিলিস্তিনের বুকে আবারও বিষাক্ত তীরের আঘাত হানলো তারই বন্ধু ও মুসলিম রাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাত। ইসরাইলকে সংযুক্ত আরব আমিরাত এক কোটি ২০ লাখ ডলার দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ ১০১ কোটি ৬৫ লাখ ৪৭ হাজার আট শ’ ৪০ টাকা।
আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে এ অর্থ ইসরাইলে বিনিয়োগ করছেন বলে জানান ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী। খবর আনাদোলু।
ইসরাইলি সামরিক বাহিনী পরিচালিত একটি রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু এ তথ্য জানান।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ইসরাইলের অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে এ অর্থ দিচ্ছেন আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের বৃহত্তম রাজ্য আবুধাবির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান ইসরাইলে ‘স্বেচ্ছায়’ ১২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছেন।
সাক্ষাতকারে নেতানিয়াহু বলেন, ‘আবুধাবির যুবরাজ বলেছেন যে করোনাভাইরাস মহামারীর পরে ইসরাইলি অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রকল্পে তিনি অংশীদার হতে চান।’
তবে নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যের পর সংযুক্ত আরব আমিরাতের কোনো বক্তব্য এখনো পাওয়া যায়নি।
কিছুদিন আগে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর। তার আমিরাত সফরের সব আয়োজনও সম্পন্ন করা হয়। একদম শেষ মুহূর্তে এসে সফরটি বাতিল করা হয়। পরে জানা গেছে, জর্ডান তার আকাশপথ ব্যবহারের অনুমতি না দেওয়ায় সফর বাতিল করা হয়েছে।
আমিরাতের বার্তা সংস্থা ডব্লিউএএমের তথ্য অনুযায়ী, নেতানিয়াহুর সফর বাতিল হওয়ার পর আমিরাত ইসরাইলে ১০ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশী মুদ্রায় ৮৪ হাজার সাত শ’ ১২ কোটি ৩২ লাখ টাকা) বিনিয়োগ তহবিল শুরু করতে সম্মতি জানায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আমিরাত সফর করতে না পেরে নেতানিয়াহুর মধ্যে যে হতাশা তৈরি হয়েছে, সেটা দূর করতেই এই অর্থ দেওয়া হয়েছে ইসরাইলকে।
দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকে আমিরাত ও ইসরায়েলের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ৩০ কোটি ডলারে (বাংলাদেশী মুদ্রায় দুই হাজার পাঁচ শ ৪১ কোটি ৩৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা) পৌঁছেছে। গত বছর আমিরাত-ইসরায়েলের মধ্যে স্বাভাবিক কূটনীতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ছাড়া ইসরাইলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নয়—এমন নীতিতেই দীর্ঘদিন চলছিল আরব দেশগুলো। কিন্তু সেই নীতি থেকে অনেকটা হঠাৎ করেই সরে আসে আমিরাত ও বাহরাইন।
আল-জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, প্রথম উপসাগরীয় আরব দেশ হিসেবে আমিরাত ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেয় গত বছরের শেষ দিকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন বছর পর ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসিত ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্ম হয়। পশ্চিমা বিশ্বের বানানো এই রাষ্ট্রকে কখনো মেনে নেয়নি আরবরা। ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও সবশেষ ১৯৭৩ সালে আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ হয় ইসরাইলের। প্রতিবারই আরবরা পরাজিত হয়। এরপর থেকেই ইহুদিদের কাছে জমি হারাতে বসে ফিলিস্তিনিরা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিন-ইসরাইল দুটি রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে সংঘাত মেটানোর চেষ্টা করলেও তা এখনো সফলতার মুখ দেখেনি।
ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আরব দেশগুলো প্রধান তিনটি শর্ত দিয়েছিল। সেগুলো হলো, যুদ্ধের সময় আরব দেশগুলোর দখল করা জমি ছেড়ে দেওয়া, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ও স্বীকৃতি এবং ফিলিস্তিনের দখল করা জমি হস্তান্তর। সেই শর্তের কোনোটা পূরণ না হওয়ার পরও আরব দেশগুলো ইহুদি রাষ্ট্রটির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। এখন পর্যন্ত আমিরাত ও বাহরাইন ছাড়া আরও দুই আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরাইলের চুক্তি হয়েছে। ১৯৭৯ সালে মিসরের সঙ্গে এবং ১৯৯৪ সালে জর্ডানের সঙ্গে চুক্তি করে দেশটি। এছাড়া সৌদি আরবের সাথে গোপন চুক্তির কথাও নতুন বছরের শুরুতে চাউর হয়। যদিও সৌদি থেকে তা অস্বীকার করা হয়।
এক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সরব সংযুক্ত আরব আমিরাত। যুক্তরাষ্ট্রের চালানো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনবরত যুদ্ধের পর সৌদিদের সঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে আরব আমিরাত। মধ্যপ্রাচ্যের নতুন এই ভাগ্যবিধাতা পেট্রো ডলার আর পশ্চিমা মদদে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে বেশ কয়েকটি দেশে। মিসরের মুরসি ও সুদানের ওমর আল বসিরকে যেভাবে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছে, ঠিক একইভাবে লিবিয়ায় হাফতার, মিসরে সিসি এবং সিরিয়ায় আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে আমিরাত ও সৌদিবলয়। আসাদ ইরানবলয়ে থাকলেও আমিরাত আসাদকে সাহায্য প্রদান করে আসছে তুরস্ক বিরোধিতার দরুন। তুরস্কের এরদোয়ান ও তিউনিসিয়ায় আন নাহদার বিরুদ্ধে বারবার চেষ্টা করেও সফল হয়নি আমিরাত। মোটকথা উপসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে আমিরাতই এখন পশ্চিমের স্বার্থ রক্ষার প্রধান খুঁটি। যেমনটি সৌদি আরব করেছে নব্বইয়ের দশকে। তাই মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে নতুন অবয়ব দিতেই আমিরাতকে বেছে নিয়েছে ইসরাইল ও আমেরিকা।
আমিরাতের এই পদক্ষেপ ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা বাড়াবে এবং স্বাধীনতার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, আরবের রাজনৈতিক ও চিন্তার জগতে বিশাল পরিবর্তন ঘটবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, লাভের মধু ইসরাইলেরই বেশি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বা সামরিক—যেটাই হোক না কেন। আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে আনাটা ইসরাইলের জন্য বড় সাফল্যই। অপরদিকে ফিলিস্তিন আবারও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হলো।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০০
আপনার মতামত জানানঃ