বহুমুখী চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি৷ একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনযাত্রাকে অসহনীয় করে তুলেছে, আরেকদিকে ডলার সংকটে প্রতিদিন কমছে রিজার্ভের পরিমান৷ এছাড়াও জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট নিকট ভবিষ্যতে দূর হবে বলেও মনে হয় না৷ সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷
এদিকে দেশে চলমান ডলার–সংকটের মধ্যে দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয় কমেছে প্রায় সাড়ে ২৪ শতাংশ। প্রবাসী আয় কমার দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত বা ইউএই। দেশটি থেকে প্রবাসী আয় আসা এক মাসের ব্যবধানে ৪১.৫০ শতাংশ কমে গেছে। অথচ সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশের দ্বিতীয় শীর্ষ শ্রমবাজার।
প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্টে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে দেশে প্রবাসী আয় এসেছিল ৩০ কোটি ৪৯ লাখ মার্কিন ডলার। সেপ্টেম্বরে তা কমে নেমে এসেছে প্রায় ১৮ কোটি ডলারে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে দেশটি থেকে প্রবাসী আয় কমেছে প্রায় ১৩ কোটি ডলার বা ৪১.৫০ শতাংশ। বাংলাদেশের দ্বিতীয় শীর্ষ এ শ্রমবাজার থেকে হঠাৎ করে প্রবাসী আয় কমে যাওয়া দুশ্চিন্তার কারণ বলেই মনে করছেন খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কাজের জন্য যত শ্রমিক বিদেশে গেছেন, তার ১৭ শতাংশই গেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বিএমইটির হিসাবে, ২০১১ থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশটিতে কাজের জন্য গেছেন প্রায় ৭ লাখ শ্রমিক। ১৯৭৬ সাল থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গেছেন প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক, যা বাংলাদেশ থেকে কাজের জন্য বিদেশ যাওয়া মোট শ্রমিকের ১৭ দশমিক ১৩ শতাংশ।
বিএমইটির হিসাবে, বাংলাদেশের শীর্ষ শ্রমবাজার সৌদি আরব। ১৯৭৬ সাল থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া শ্রমশক্তির ৩৬ শতাংশই গেছে দেশটিতে। সংখ্যার দিক থেকে যা প্রায় ৫২ লাখ। এর মধ্যে ২০১১ সালের পর গেছে প্রায় ২৬ লাখ বাংলাদেশি। এ বাজার থেকেও আগস্টের তুলনায় গত সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয় কমেছে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি ডলার বা ১০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয় প্রেরণকারী শীর্ষ দেশ ছিল সৌদি আরব। দ্বিতীয় স্থানে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, তৃতীয় অবস্থানে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এরপরের অবস্থানে ছিল যথাক্রমে যুক্তরাজ্য, কুয়েত, কাতার, ইতালি ও মালয়েশিয়া। এসব দেশের মধ্যে ইতালি থেকে আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ৩২ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাড়ে ২২ শতাংশ, যুক্তরাজ্য থেকে ২৯ শতাংশ, কুয়েত থেকে ১৮ শতাংশ, কাতার থেকে সাড়ে ১৩ শতাংশ, মালয়েশিয়া থেকে ২৭ শতাংশ প্রবাসী আয় আসা কমে গেছে।
কেন কমছে
ব্যাংক ও জনশক্তি রপ্তানি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, হুন্ডির কারণেই মূলত ইউএই থেকে প্রবাসী আয় এভাবে কম গেছে। সৌদি আরব থেকেও প্রবাসী আয় কমার কারণ মূলত হুন্ডি। এ ছাড়া বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এ দুই দেশেও জীবনযাত্রার খরচ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। ফলে প্রবাসীরা আগের মতো আয় পাঠাতে পারছেন না।
আরব আমিরাত হুন্ডির একটি হাব হিসেবে কাজ করে। এসব দেশে এখন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী রিয়েল এস্টেটসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছে। তাই সেখানে ফরেন কারেন্সির ডিমান্ড আগের তুলনায় বেড়েছে। সেসব কারেন্সির যোগান দিতে হুন্ডিও স্বাভাবিকভাবে বাড়বে।
সম্প্রতি প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ দাম ঠিক করা হয় ১০৮ টাকা। বলা হয়, কোনো ব্যাংকের এ দামের চেয়ে বেশি দামে প্রবাসী আয় আনতে পারবে না।
ব্যাংকাররা বলছেন, গত ১২ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের ডলারের দাম ১০৮ টাকা নির্ধারণ করার কারণেই মূলত রেমিট্যান্সে এই ধ্বস নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপে সেটিকে আবার কমিয়ে ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে।
ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মূলত দাম বেঁধে দেওয়ার পর থেকে প্রবাসী আয় কমতে শুরু করে। কারণ, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠালে তাতে বেশি লাভ হয় প্রবাসীদের। ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের দামে তিন–চার টাকার ফারাক রয়েছে। তাই হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠালে তাতে বেশি মুনাফা পাওয়া যায়। তা ছাড়া বৈধ পথের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম ঝামেলায় হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানো যায়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, “আরব আমিরাত হুন্ডির একটি হাব হিসেবে কাজ করে। এসব দেশে এখন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী রিয়েল এস্টেটসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছে। তাই সেখানে ফরেন কারেন্সির ডিমান্ড আগের তুলনায় বেড়েছে। সেসব কারেন্সির যোগান দিতে হুন্ডিও স্বাভাবিকভাবে বাড়বে।”
সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বৈধভাবে প্রবাসীরা টাকা পাঠাতে না পারার কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসছে বলে মনে করছেন দেশটিতে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এ প্রবণতা কমিয়ে আনতে না পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলেও ধারণা তাদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ২৪৪ কোটি ডলার। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ হয়েছে ২৪৭ কোটি ডলারেরও বেশি।
পরিসংখ্যান বলছে, দেশটি থেকে ক্রমান্বয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহের হার কমে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। একই সঙ্গে এটি দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের জন্যও উদ্বেগজনক।
সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর বৈধতা না পেলেও অনেকেই বিকাশ, নগদ, রকেটের মাধ্যমে অবৈধভাবে টাকা পাঠান বাংলাদেশে। সচেতন মহলের দাবি, অবৈধ পথে প্রবাসীদের টাকা লেনদেনের কারণে রেমিট্যন্স প্রবাহ কমে আসছে।
সহজ পদ্ধতি এবং দ্রুতগতির কারণে এ পদ্ধতি অনুসরণ করছে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি। এতে ধীরে ধীরে এক্সচেঞ্জ বা ব্যাংকের মাধ্যমে বৈধ পথে টাকা প্রেরণের প্রবণতা কমে যাচ্ছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে এসব লেনদেনের প্রবণতা চোখে পড়ে বেশি। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি আরও কমে আসবে বলে আশঙ্কা করছেন প্রবাসীরা।
বিশ্লেষকরা বলেন, বলেন, দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রবাসী আয় আসা প্রায় ৪১.৫০ শতাংশ কমে যাওয়া উদ্বেগের বিষয়। কেন এভাবে দেশটি থেকে হঠাৎ করে প্রবাসী আয় আসা এতটা কমে গেল, তা খতিয়ে দেখে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়লে তাতে অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৭
আপনার মতামত জানানঃ