চলতি বছরের মার্চে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে আব্রাহামিক ফ্যামিলি হাউস নামের একটি জৌলুশপূর্ণ কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করা হয়। তিনটি প্রসিদ্ধ আব্রাহামিক ধর্মের (ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিষ্টান) তিনটি আইকনিক উপাসনালয় নিয়ে নির্মিত কমপ্লেক্সটি এরই মধ্যে আন্তধর্মীয় সংলাপ ও সম্প্রীতির বৈশ্বিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই কীভাবে একজন মসজিদের ইমাম, গির্জার বিশপ ও সিনাগগের রাব্বি একসঙ্গে চলতে পারেন—তা মানুষের সামনে তুলে ধরাই কমপ্লেক্সটি প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য। যদিও এ নিয়ে অনেকে আপত্তিও জানাচ্ছেন।
আব্রাহামিক ফ্যামিলি হাউস আবুধাবির সাদিয়াত সাংস্কৃতিক জেলায় অবস্থিত। এর পাশেই রয়েছে বিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়ামের আবুধাবি শাখা, জায়েদ ন্যাশনাল মিউজিয়ামসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ছড়িয়ে দিতে ২০১৯ সালে এই কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ শুরু করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ভিত্তিফলকে দেশটির প্রেসিডেন্ট শেখ মুহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান, দুবাইয়ের শাসক শেখ মুহাম্মদ বিন রশিদ, পোপ ফ্রান্সিস ও কায়রোর আল-আজহার গ্র্যান্ড মসজিদের ইমাম আহমেদ আল-তাইয়েবের স্বাক্ষর রয়েছে।
ঘানা বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ স্থপতি স্যার ডেভিড অ্যাডজায়ে আব্রাহামিক ফ্যামিলি হাউসের নান্দনিক নকশাটি তৈরি করেন। যথেষ্ট প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের ব্যবস্থাসহ কমপ্লেক্সের নকশা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘মানুষের জীবনে সমৃদ্ধি আনাই আমার নকশার উদ্দেশ্য। এই স্থাপনায় বিচরণের মাধ্যমে সব ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রয়োজনীয় দিকগুলো শিখবে।’
আব্রাহামিক ফ্যামিলি হাউসে তিনটি অত্যাধুনিক উপাসনালয় রয়েছে। প্রতিটিরই দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা ৩০ মিটার। কমপ্লেক্সের ভেতরের প্রতিটি লেখা তিনটি ভাষায়—আরবি, ইংরেজি ও হিব্রু।
এ ছাড়া প্রতিটি উপাসনালয়ের পাশেই রয়েছে পবিত্র হওয়ার ব্যবস্থা। গির্জার পাশে ব্যাপটিস্ট্রি, সিনাগগের পাশে মিকভা এবং মসজিদের পাশে অজুখানা। পুরো কমপ্লেক্সেই রয়েছে ত্রিভুজ আকৃতির ছোট-শান্ত হ্রদ, যা তিন ধর্মের সহাবস্থানকে উপস্থাপন করে।
চুনাপাথরের তৈরি ভবনগুলোর সামনের দিকে নকশা প্রতিটি ধর্মের স্বতন্ত্র বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করে। ক্যাথলিক গির্জাটির নাম রাখা হয়েছে হোলিনেস ফ্রান্সিস চার্চ। সোজাসুজি অনেকগুলো কলাম দিয়ে বাইরের নকশা করা হয়েছে। এতে একসঙ্গে ৩০০ জন বসার ব্যবস্থা রয়েছে।
মসজিদের নাম আহমেদ আল-তাইয়েব মসজিদ। এর সামনের দিকে রয়েছে সাতটি খিলান, যা ইসলামের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা। মসজিদে ৩২২ জন মুসল্লির একসঙ্গে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে নারীদের নামাজের স্থানও।
সিনাগগের নাম রাখা হয়েছে ইহুদি দার্শনিক মোজেস বেন মাইমনের নামে। সিনাগগের দেয়ালে ইহুদি ধর্মের ১০ আদেশ (টেন কম্যানডেন্ট) লেখা হয়েছে। এর বাইরের নকশা ত্রিভুজ আকৃতির, যা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর তাঁবু, নিরাপত্তা ও আতিথেয়তার প্রতীক।
কমপ্লেক্সের মসজিদটির নাম আহমেদ আল-তাইয়েব মসজিদ। এর সামনের দিকে রয়েছে সাতটি খিলান, যা ইসলামের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা। ছবি: আরব নিউজ
কমপ্লেক্সের মসজিদটির নাম আহমেদ আল-তাইয়েব মসজিদ। এর সামনের দিকে রয়েছে সাতটি খিলান, যা ইসলামের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা। ছবি: আরব নিউজ
তিনটি আব্রাহামিক ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে শান্তি ও সংলাপের বন্ধন তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে এই এটি নির্মিত। এই স্থাপত্য মোগল বাদশাহ আকবরে দিন-ই-ইলাহির মতো কিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ২০১৯ সালে পোপ ফ্রান্সিস ও আল-আজহারের গ্র্যান্ড ইমাম আহমেদ আল-তাইয়েবের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে নির্মিত হয় আব্রাহামিক ফ্যামিলি হাউস। উদ্যোক্তারা বলেছেন, এর উদ্দেশ্য কোনোভাবেই তিন ধর্মকে এক করে ফেলা নয়। যদিও প্রথম দিকে অনেকেই এই বিষয়ে বিভ্রান্ত ছিলেন।
কমপ্লেক্সে অবস্থিত আহমেদ আল-তাইয়েব মসজিদের ইমাম মাহমুদ নাগাহ বলেন, ‘প্রথম যখন এই কমপ্লেক্স নির্মাণ শুরু হয়, তখন অনেকের মধ্যেই ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁরা মনে করেছিলেন, এটি তিন ধর্মকে এক করে আব্রাহামিক ধর্ম নামের একটি নতুন ধর্ম তৈরির মিশন।’
মাহমুদ নাগাহ আরও জানান, এই ভুল-বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে তিনি মানুষের সামনে বিষয়গুলো তুলে ধরেছিলেন। কীভাবে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে পাশাপাশি ধর্মগুলো অবস্থান করতে পারে, তা ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য হলো, মুসলমানেরা যখন মসজিদে আসবেন, তখন যেন তাঁরা নিজে থেকেই বলেন—এটি তো আমিরাতের অন্য মসজিদগুলোর মতো একটি সাধারণ মসজিদই।
তিনটি উপাসনালয়ই আকারে আয়তনে সমান। মাহমুদ নাগাহ বলেন, ‘আমরা এখানে (মসজিদে) গির্জা ও সিনাগগ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করছি। তা সত্ত্বেও আমরা এক স্থানে জড়ো হই এবং আন্তধর্মীয় সংলাপে অংশ নিই। যে দিকগুলো আমাদের ধর্মে এক, সেসব বিষয়ে আমরা আলাপ করি।’
মাহমুদ আরও বলেন, ‘ধর্মগুলোকে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়। বরং সবাইকে ঐক্যের সুতোয় গাঁথাই ধর্মীয় বিশ্বাসের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আমি মনে করি, মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু অজ্ঞতা, যা মানুষে-মানুষে যোগাযোগ গড়ে তোলার প্রধান অন্তরায়।’
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুতে, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কো ইসরায়েলের সঙ্গে মার্কিন মধ্যস্থতায় সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। এর ফলে আমিরাতে ইসরায়েলের জন্য বাণিজ্য, কূটনীতি ও নিরাপত্তা সহযোগিতার দরজা খোলে। সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এই প্রক্রিয়াকে বিশ্বের অনেক দেশ ও মুসলমানেরা স্বাভাবিকভাবে না নিলেও আমিরাতে ইহুদিদের আগমন ঠেকানো যায়নি।
আব্রাহামিক ফ্যামিলি হাউসের মোজেস বেন মাইমন সিনাগগের প্রধান রাব্বি ইয়াহুদা সারনা বলেন, ‘এটি উপসাগরীয় অঞ্চলে ১০০ বছরের মধ্যে প্রথম বিশেষ উদ্দেশ্যে নির্মিত সিনাগগ। আমিরাতে ইহুদিদের সংখ্যা বাড়ছে। কারণ এখানে মানুষ নিরাপদ বোধ করছে। বিলাসী জীবন পাচ্ছে।’
ইয়াহুদা সারনা আরও বলেন, ‘আমি ২০১০ সালে কানাডা থেকে আমিরাতে এসেছি। বিশ্বব্যাপী যখন ইহুদি-বিদ্বেষ বেড়েই চলেছে, তখন ইহুদিরা আমিরাতে নিরাপদ বোধ করছে। এখানে হলোকাস্ট থেকে বেঁচে ফেরাদের সন্তানেরা যেমন রয়েছে, তেমনি ইয়েমেনে হুতিদের হাতে নির্যাতিত ইহুদিরাও রয়েছে। সাদ্দামের আমলে ইরাক থেকে পালিয়ে আসা ইহুদি যেমন রয়েছে, ইরান থেকে চলে আসা ইহুদিও রয়েছে।’
আব্রাহামিক ফ্যামিলি হাউসের প্রাথমিক সাফল্যে উচ্ছ্বসিত রাব্বি ইয়াহুদা সারনা বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এমন প্রকল্প দেখতে চান, যেখানে শত মতপার্থক্য থাকার পরও সব ধর্মের অনুসারীরা সহাবস্থান করতে পারবে। আহমেদ আল-তাইয়েব মসজিদের ইমাম মাহমুদ নাগাহও তাঁর সঙ্গে একমত।
কমপ্লেক্সে অবস্থিত ফ্রান্সিস চার্চের প্রধান যাজক পাওলো মার্তিনেলি বলেন, ‘এখানে প্রার্থনা করতে একত্র হওয়া চমৎকার ব্যাপার। আমাদের বিশ্বাস স্পষ্টই আলাদা। তবে আমরা একই পরিসরে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম পালন করছি। আমরা বিশ্বকে দেখাতে চাই, বিশ্বাস আলাদা হলেও একসঙ্গে কাজ করা সম্ভব।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ