পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আতঙ্কে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাদান বন্ধ করার হিড়িক পড়েছে বিভিন্ন দেশে। টিকা গ্রহীতার রক্তে জমাট বাঁধা ও কয়েকজনের মৃত্যুর খবরে এই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা অনিরাপদ ও অকার্যকর বলে ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে এর প্রয়োগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
ডেনমার্ক
টিকার ডোজ নেওয়ার পর জমাট বাঁধছে রক্ত— এমন রিপোর্ট সামনে আসার পরই অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা সাময়িকভাবে বন্ধ করেছে ডেনমার্ক। গত বৃহস্পতিবার(১১ মার্চ) এমনটাই জানা গিয়েছে ওই দেশের সরকার সূত্রে। তবে কতজনের শরীরে এমন সমস্যা দেখা দিয়েছে তা নিয়ে কিছু বলেনি ডেনমার্কের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
ড্যানিশ স্বাস্থ্য বিভাগের ডিরেক্টর সোরেন ব্রস্ট্রম একটি বিবৃতিতে জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং ড্যানিশ মেডিসিন সংস্থা এই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে জবাব দেবে। আপাতত ১৪ দিনের জন্য টিকাকরণ বন্ধ রাখা হচ্ছে। তবে অসুস্থ রোগীর সম্পর্কে কোনও তথ্য দেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ।
তবে ডেনমার্কের অভিযোগের পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিয়েছে অ্যাস্ট্রেজেনেকা। জানিয়েছে, ভ্যাকসিনের গুণমান নিয়ে যথেষ্ট দায়িত্বশীল সংস্থা। গুণমান নিয়ে অভিযোগ উদ্বেগের। এখনও পর্যন্ত কোনও গুরুতর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার খবর মেলেনি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সময়।
নরওয়ে
ডেনমার্কের মতো নরওয়েতেও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাদান বন্ধ ঘোষণা করেছে।
নরওয়ের সরকারি স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট জানিয়েছে, ডেনমার্কের মতোই তারা ভ্যাকসিনের প্রয়োগ স্থগিত রাখবে।
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের গেই বুখলম বলেন, ভ্যাকসিন ও রক্তের জমাট বাঁধার বিষয়ে আরও তথ্যের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি।
অস্ট্রিয়া
চলতি সপ্তাহে অস্ট্রিয়া অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের একটি ব্যাচ প্রয়োগ বাতিল করে। ভ্যাকসিন নেওয়ার দশ দিনের মাথায় এক নারীর মৃত্যুর পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
অস্ট্রিয়ার এই ব্যাচটি ইউরোপের ১৭টি দেশে পাঠানো এবিভি৫৩০০ নামের ব্যাচের ১০ লাখ ডোজের অংশ। এস্টোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও লুক্সেমবার্গও ওই ব্যাচটি প্রয়োগ বাতিল করেছে।
তবে ডেনমার্ক ও অস্ট্রিয়ার স্বাস্থ্যবিভাগের সঙ্গে যৌথ তদন্তে রাজি অ্যাস্ট্রাজেনেকা। ইউরোপিয়ান মেডিসিন সংস্থা বুধবার জানিয়েছে, অস্ট্রিয়ার মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে টিকার কোনও সম্পর্ক নেই।
ইতালি
সাময়িকভাবে অক্সফোর্ড উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন স্থগিত করেছে ইতালিও। সিসিলি দ্বীপে দুজন পুরুষ রোগী আ্যস্ট্রোজেনেকার ভ্যাকসিন নেয়ার পর মৃত্যুবরণ করার কারণে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
ইতালির নৌবাহিনী ৪৩ বছর বয়সী একজন অফিসার এবং ৫০ বছর বয়সী এক পুলিশ কর্মকর্তা এ টিকা নেওয়ার পর মারা গেছেন।
গতকাল (১১ মার্চ) এক বিবৃতিতে ইতালির ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এআইএফএ এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পূর্ব সতর্কতামূলক দেশজুড়ে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বলা হচ্ছে—এই ভ্যাকসিন নেওয়ার পর অনেকের দেহে রক্তজমাট বেঁধে যাচ্ছে এবং এ নিয়ে ইউরোপজুড়ে একরকমের ভয় ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এখনও সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে, এই ভ্যাকসিন গ্রহণের কারণেই এসব সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
থাইল্যান্ড
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর আসার পর থাইল্যান্ডে অ্যাস্ট্রজেনেকার করোনার টিকাদান কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
আজ শুক্রবার(১২ মার্চ) প্রধানমন্ত্রীর টিকা গ্রহণের মধ্য দিয়ে থাইল্যান্ডে টিকাদান কার্যক্রম উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল, তবে এই টিকায় ‘রক্ত জমাট বাধায়’ বলে খবর আসলে টিকাদান কার্যক্রমের উদ্বোধন বন্ধ করা হয়।
আইসল্যান্ড
আইসল্যান্ডও ডেনমার্ক নরওয়ের পথে হাঁটতে যাচ্ছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আতঙ্কে তারাও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাদান বন্ধ করার চিন্তাভাবনা করছে।
আইসল্যান্ডের শীর্ষ এপিডেমিওলজিস্ট জানিয়েছেন, তারাও সতর্ক পদক্ষেপ হিসেবে ভ্যাকসিন প্রয়োগ স্থগিত করতে যাচ্ছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রয়োগে সম্ভবত আফ্রিকাই প্রথম নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই তারা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করে।
করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের বিরুদ্ধে ‘হতাশাজনক’ ফলাফল পাওয়ায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন প্রয়োগ স্থগিত করে দক্ষিণ আফ্রিকা।
দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ট্রায়ালে দুই হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল এবং ফলাফলে দেখা গেছে, ভ্যাকসিনটি করোনাভাইরাসের মৃদু ও মধ্যম সংক্রমণের বিরুদ্ধে সামান্য সুরক্ষা দেয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনার ৯০ শতাংশ সংক্রমণের জন্য দায়ী নতুন ধরনটি।
দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জুয়েলি এমখিজে বলেন, এই ফলাফলের আলোকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন দিয়ে কীভাবে এগিয়ে যেতে হবে সে সম্পর্কে সরকার আরও পরামর্শের জন্য অপেক্ষা করবে। ট্রায়ালটি ইউনিভার্সিটি অফ দ্য উইটওয়াটার্সর্যান্ড দ্বারা পরিচালিত হয় এবং এখন পর্যন্ত ফলাফল পিয়ার-রিভিউ করা হয়নি।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা নিয়ে মন্তব্য
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা নিরাপদ ও কার্যকর বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার। কানাডাও বলছে, এই টিকা নিরাপদ।
ডেনমার্ক, নরওয়ে, আইসল্যান্ড, থাইল্যান্ড গতকাল বৃহস্পতিবার সাময়িকভাবে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনার টিকার ব্যবহার স্থগিত করে। তারপরই এই টিকার নিরাপত্তার পক্ষে যুক্তরাজ্য ও কানাডা থেকে বক্তব্য এল।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের মুখপাত্র গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এই ব্যাপারটিতে পরিষ্কার যে এই টিকা নিরাপদ ও কার্যকর।’
লোকজনের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন বরিস জনসনের মুখপাত্র।
যুক্তরাজ্য সরকার অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাদান চালিয়ে যাবে বলেও জানানো হয়েছে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা বলেছে, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এই টিকার নিরাপত্তার দিকটি ব্যাপকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।
কোনো নতুন ওষুধ অনুমোদনের ক্ষেত্রে তার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো অনুসরণ করে বলে জানায় অ্যাস্ট্রাজেনেকা।
যুক্তরাজ্যের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি এজেন্সি (এমএইচআরএ) বলেছে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা সমস্যা তৈরি করেছে বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। লোকজনের এই টিকা নেওয়া উচিত।
যুক্তরাজ্যে ১ কোটি ১০ লাখের বেশি মানুষ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়েছে বলে জানিয়েছে এমএইচআরএ।
ইউরোপীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এক বিবৃতিতে বলেছে, রক্ত জমাট বাঁধার সঙ্গে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার যোগসূত্র থাকার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
কানাডার স্বাস্থ্য বিভাগ গতকাল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিরাপদ। তারা কানাডাবাসীকে এই টিকার সুবিধার ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে চায়। এই টিকায় এখন পর্যন্ত কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ঘটনা নেই।
কানাডা গত সপ্তাহে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ৫ লাখ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পেয়েছে। আগামী মে মাস নাগাদ তারা আরও ১৫ লাখ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পাওয়ার আশা করছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্য প্রথম অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেয়।
বাংলাদেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার অবস্থা
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। সেরামের কাছ থেকে ব্রিটিশ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের টিকার ৩ কোটি ডোজ কিনতে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ।
দেশে সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৯০ লাখ ডোজ টিকা এসে পৌঁছেছে। গত ২০ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো টিকা এসে পৌঁছায়। সেটা ছিল ভারত সরকারের উপহার হিসেবে দেওয়া ২০ লাখ ডোজ। পরবর্তীতে ২৫ জানুয়ারি আসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা, যা ছিল সেরামের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তির আওতায় প্রথম চালান। তারপর দ্বিতীয় চালান হিসেবে এসেছে আরও ২০ লাখ ডোজ।
২৭ জানুয়ারি দেশে প্রথম টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়। ওই দিন রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে একজন নার্সকে দেওয়ার মাধ্যমে পরীক্ষামূলক এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পর সারাদেশে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু হয় গত ৭ ফেব্রুয়ারি।
তবে অক্সফোর্ড- অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ব্যবহারে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিংবা আপত্তি ওঠেনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৫৯
আপনার মতামত জানানঃ