ইয়াঙ্গুনে জান্তাবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের এবং অং সান সু চির দল ‘দ্য ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি’-এর নেতা-কর্মীদের খোঁজে নিরাপত্তা বাহিনীর রাতভর অভিযান সত্ত্বেও সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অন্যতম বড় বিক্ষোভ কর্মসূচিতে রোববার অন্তত দশ হাজার মানুষ মিয়ানমারের বিভিন্ন রাস্তায় জড়ো হয়েছেন।
শনিবার রাতে ইয়াঙ্গুন থেকে এনএলডি-এর একজন আঞ্চলিক ক্যাম্পেইন ম্যানেজার গ্রেফতার হবার পর কারাগারে মারা গেছেন বলে জানান, পার্লামেন্টের একজন প্রাক্তন সদস্য। যদিও খিন মাং ল্যাটের মৃত্যু সম্পর্কে জানা যায়নি কোন তথ্য, তবে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একটি ছবিতে খিন মাং ল্যাটকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।
রবিবারের বিক্ষোভে রাষ্ট্র পরিচালিত গণমাধ্যমে সাংসদদের সতর্ক করে জানায়, নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত সরকার ‘দ্য কমিটি রিপ্রেজেনটিং পিদংসু হ্লুত্তাও’ (সিআরপিএইচ) দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। তাদের মৃত্যুদণ্ড কিংবা ২২ বছরের জেলও হতে পারে।
মিয়ানমার সেনা ঘোষণা করেছে, যার সিআরপিএইচ-এর সাথে যোগাযোগ করবে বা কোনভাবে যুক্ত হবে, তাদ্রর সাত বছরের সাজা হতে পারে।
উল্লেখ্য, ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন সেনাবাহিনী নির্বাচিত নেত্রী অং সান সু চিসহ বেসামরিক সরকারের শীর্ষ নেতাদের আটক এবং রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে অচলাবস্থার সূচনা হয়। এই সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে নভেম্বরের নির্বাচনে সু চির দলের কারচুপির অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রায় ৪৯ বছরের সেনা শাসনের এক দশক পর, জান্তাসরকারের এই জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল, প্রাত্যহিক বিক্ষোভ ও অবরোধের কর্মসূচির সূচনা করেছে। যার কারণে ব্যবসায়িক পরিবেশ রুদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অচল হয়ে গেছে দেশটির দৈনন্দিন প্রশাসনিক কার্যক্রম।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে সামরিক জান্তা সরকারের হাতে অন্তত ৫৪ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। এরপরও বিক্ষোভকারীরা প্রতিদিনেই রাস্তায় নামছেন এবং গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির মুক্তিসহ গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা ফিরয়ে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন।
দেশজুড়ে নাজুক হচ্ছে যুদ্ধপরিস্থিতি
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ঐতিহাসিক মন্দিরের শহর বাগানে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি ছুঁড়েছে পুলিশ; তবে তারা তাজা বুলেট না রবার বুলেট ব্যবহার করছে তা নিশ্চিত নয়। এই ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
বাগান শহরের বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে অন্ততপক্ষে ৫ জন আহত হয়েছে বলে জানা যায়। একটি ছবিতে দেখা যায় এক বিক্ষোভকারী থুতনি ও কাঁধে ক্ষত নিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। ধারণা করা হয়, বিক্ষোভকারীদের উপর রাবার বুলেট ছুঁড়েছে পুলিশ। রাস্তায় বুলেটের খোসা থেকে জানা যায়, রাবার বুলেটের পাশাপাশি তাজা গুলিও ছুঁড়েছে পুলিশ।
ফেইসবুকে পোস্ট করা ভিডিও অনুযায়ী, দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় শান প্রদেশের লাশিও শহরে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদুনে গ্যাস ও স্টান গ্রেনেড ছুঁড়েছে।
এদিন সবচেয়ে বেশি লোক জমায়েত হয়েছে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ে। ভিডিওতে দেখা গেছে, এখানে আন্দোলনকারীরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহতদের স্মরণে দুই মিনিট নীরবতা পালন করার পর অবস্থান ধর্মঘট করছেন।
ইয়াঙ্গুনের অন্তত তিনটি স্থানে বিক্ষোভ সংঘটিত হয়েছে। এসব অঞ্চলের অধিবাসীরা জানান, পুলিশ ও সেনা সদস্যরা আগের রাতে কয়েকটি জেলায় অভিযান চালিয়ে গুলি ছুঁড়েছে। কিয়াকতাদা এলাকা থেকে অন্তত তিনজনকে আটক করা হয়েছে। কেন তাদেরকে আটক করা হয়েছে তা জানা যায়নি।
সেনাদের স্বেচ্ছাচারিতা
গ্রেফতারের সময় এক নারী চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘তারা আমার বাবা ও ভাইকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। কেউ কি আমাদের সাহায্য করবে না? আপনারা আমার বাবা ও ভাইকে স্পর্শ করবেন না। ওদের নিয়ে যেতে চাইলে আমাদেরও নিয়ে যান।’ গ্রেফতার হওয়া এই দু’জনের একজন পেশায় অভিনেতা, আরেকজন তার ছেলে।
সেনাবাহিনী একজন আইনজীবীর খোঁজও করছিল যিনি অং সান সুচির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) পক্ষে কাজ করেছিলেন। তবে সেনা সদস্যরা তাকে খুঁজে পায়নি।
এ বিষয়ে পুলিশের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। সেনা সরকারের মুখপাত্রকে রয়টার্স থেকে ফোন করা হলে তিনি সাড়া দেননি।
এদিকে, উ মাং মাং-এর ভাইকে পুলিশ এবং সেনারা কাউকে গ্রেফতার করতে না পেরে বেধড়ক মারধর করে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখে, বলে জানিয়েছে একজন প্রাক্তন সাংসদ।
মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর দাউইর একজন আন্দোলনকারী নেতা জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, তারা মানুষকে পাখির মতো হত্যা করছে। তাদের বিরুদ্ধে যদি বিদ্রোহ না করি আমরা তাহলে কী করবো? আমরা অবশ্যই বিদ্রোহ করবো।
অ্যাসিসটেন্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স গোষ্ঠী জানিয়েছে, শনিবার পর্যন্ত সর্বমোট এক হাজার ৭০০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে জান্তা কর্তৃপক্ষ। তবে শুক্রবার দিবাগত রাতে কতোজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সে সংখ্যাটি জানাতে পারেনি তারা।
বর্তমান পরিস্থিতি
অভ্যুত্থানের এক মাসেরও বেশি সময় কেটে গেছে। দেশটির মানুষ ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট, রাতভর সেনা অভিযান, অবৈধভাবে গ্রেপ্তার, বিক্ষোভকারীদের রাস্তায় ধাওয়া ও মারধর করা, ফাঁকা গুলি ছোঁড়া বা দূর থেকে মাথা বা বুক লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন।
এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে বহু বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। একজন কমবয়েসী তরুণী মাথায় গুলি লেগে মারা যান। তার পরনে টি শার্টে লেখা ছিল, এভ্রিথিং উইল বি ওকে’ অর্থাৎ ‘সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে’।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইদানিং যদি আপনি দিনের বেলা ইয়াঙ্গুনের আশেপাশে থাকেন, তবে আপনার প্রথম যে বিষয়টি নজরে আসবে তা হল তীব্র ঝাঁঝালো ধোঁয়ার গন্ধ। সেখানকার ছোট ছোট শিশুদের পর্যন্ত নিজ বাড়ির ভেতরে কাঁদানে গ্যাসের স্বাদ নিতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মায়েদের অভিশাপ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
তাজা বুলেট, রাবার বুলেট, স্টান গ্রেনেড, জল কামান, কাঁদানে গ্যাস। যেটার নামই আপনি বলুন, মিয়ানমার এক মাসেরও কম সময়ে মধ্যে এর সবকটির দেখা পেয়েছে। এরপরও প্রতিদিন নতুন করে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করছে সাধারণ মানুষ। সামরিক জান্তার নৃশংসতায় বিক্ষোভকারীরা ক্রোধে ফুঁসে উঠলেও – এখন পর্যন্ত তাদের বেশিরভাগ বিক্ষোভই ছিল শান্তিপূর্ণ।
নারীদের লুঙ্গি ব্যারিকেড
মিয়ানমারের নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক লুঙ্গি। ঊর্ধ্বাঙ্গে ব্লাউজের সঙ্গে শরীরের নিচের অংশে রঙিন লুঙ্গি পরেন তাঁরা। আমাদের দেশে যদিও এ পোশাক থামি নামে পরিচিত। তবে মিয়ানমারে তা লুঙ্গি নামে সবাই চেনে। চলমান আন্দোলনে জান্তার বিরুদ্ধে অন্যতম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে এ লুঙ্গি।
শুধু কী লুঙ্গি, পথের ব্যারিকেডে শোভা পাচ্ছে নারীদের স্কার্ট, পাজামাসহ রংবেরঙের নানান পোশাক। মূলত শরীরের নিচের অংশে ব্যবহার হওয়া পোশাক ব্যারিকেডে ব্যবহার হচ্ছে। সেনা চলাচলের পথগুলোয় আড়াআড়ি রশি বেঁধে সেখানে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এসব পোশাক। এমনকি পথের মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে নারীদের পোশাক। এতে কাজও হচ্ছে। অনেক এলাকা মাড়াচ্ছেন না নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন।
মিয়ানমারের লোকসমাজে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। দেশটির আন্দোলনকর্মী থিনজার সুন লেই ই জানান, এখানকার পুরুষদের বিশ্বাস, নারীদের ঝুলন্ত পোশাকের নিচ দিয়ে যাওয়াটা তাদের পৌরুষত্বের জন্য অবমাননাকর। এতে তাদের পৌরুষের গর্ব ভূলুণ্ঠিত হবে। মূলত এ কারণে রাজপথে নারীদের লুঙ্গি ব্যারিকেডের নিচ দিয়ে যেতে চাইছে না সেনা-পুলিশরা।
আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সেনা–পুলিশের জন্য নারীদের এ লুঙ্গি ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়া কোনো বিষয়ই না। তবে বাস্তবে তা ঘটছে না। এ ব্যারিকেড ভাঙতে নারাজ সেনা বা পুলিশ। এমনকি রাস্তায় আড়াআড়ি ঝুলতে থাকা নারীদের পোশাকের নিচে দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে তাদের ঘোর আপত্তি।
থিনজার সুন লেই বলেন, চলমান বিক্ষোভে জান্তার বিরুদ্ধে মিয়ানমারের নারীদের এটা একটা রক্ষণাত্মক কৌশল।
মিয়ানমার ছাড়তে শুরু করেছে নাগরিকরা
মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সাং সু চিকে আটক করে শাসনভার নিয়ে নিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। এখন সেনাবাহিনীর গুম-অপহরণ-হত্যা আর গ্রেফতার আতঙ্কে অতিষ্ঠ নাগরিকরা এবার মিয়ানমার ছাড়তে শুরু করেছেন।
মিয়ানমারের ভারত সীমান্তবর্তী কর্মকর্তারা জানান, সেনা অভ্যুত্থানের অশান্তি এড়াতে প্রায় অর্ধশত মিয়ানমার নাগরিক সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পড়েছেন। অপেক্ষায় আছেন আরও ৮৫ জনের একটি দল।
এদিকে ভারতের আসাম রাইফেলস প্যারামিলিটারি ফোর্সের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান, ইতোমধ্যে ৮ পুলিশসহ ৪৮ জন মিয়ানমার নাগরিক ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় মিজোরাম রাজ্যে প্রবেশ করেছে। আরো কমপক্ষে ৮৫ মিয়ানমার নাগরিক ভারতে প্রবেশের অপেক্ষায় আছেন।
ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য হিন্দু জানায়, পুলিশসহ যারা ইতোমধ্যে ভারতে প্রবেশ করেছে- তারা মিয়ানমারের বর্তমান জান্তা সরকারের অধীনে কাজ করতে চান না।
এসডব্লিউ/এসএস/২১৩৩
আপনার মতামত জানানঃ