সম্প্রতি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার মূলহোতা হিসাবে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে দোষী করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের প্রকাশ করা এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাশোগিকে আটক কিংবা হত্যার একটি পরিকল্পনা অনুমোদন করেন যুবরাজ। খাসোগি হত্যাকাণ্ডে সৌদি যুবরাজের সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ হলে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল—সৌদির মেগাসিটি প্রকল্প ‘নিওম’ এতে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তবে এসবে সৌদির মেগাসিটি প্রকল্পে কোনো চোট পড়বের না বলে জানিয়েছে বিশ্লেষকরা।রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুবরাজের বিরুদ্ধে মার্কিন এই প্রতিবেদনে মেগাসিটিতে বিনিয়োগকারীদের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। যদি না যুক্তরাষ্ট্র যুবরাজের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো পদক্ষেপ না নেয়।
অ্যাজুরে স্ট্রাটেজির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক পরামর্শক নীল কুইলিয়াম রয়টার্সকে বলেন, বিনিয়োগকারীরা বাইডেন প্রশাসন থেকে বড় কোনো অঘটন আশঙ্কা করেছিল। যদি বাইডেন সরকার কেবলি প্রতিবেদনে যুবরাজকে দোষী সাব্যস্তে সীমাবদ্ধ থাকে তবে এটা খুবই দুর্বল যা বিনিয়োগকারীদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না।
তিনি বলেন, আমি এটিকে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা হিসাবে দেখছি না যেখানে বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলো সৌদি রাজ্যের কাছে সুযোগ খুঁজে যাচ্ছে।
কুইলিয়াম বলেন, ২০০০ সালের গোড়ার দিকেও সৌদি বাদশাহর অর্থনৈতিক সিটি প্রকল্পসহ ‘গিগা প্রকল্পসমূহ’ নিয়েও বিভিন্ন সংশয় ছিল, কিন্তু তা কখনো বন্ধ হয়নি।
সৌদি আরব বিশ্বের দ্বিতীয় তেল উৎপাদনকারী দেশ। তেল উৎপাদনে বিশ্বে সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। উৎপাদন সক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে সৌদি আরব সামান্য পিছিয়ে আছে।
নিওমের প্রধান নির্বাহী নাদমি আল নাসর বলেন, নিওমের সব কিছুই ভবিষ্যত ভিত্তিক ও দূরদর্শী। তিনি বলেন, আমরা সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করব।
সৌদি সরকার যখন বলছে এই মেগাসিটি বিশ্বের মহাপ্রাণ ব্যক্তি ও সেরা মেধাবীদের আকৃষ্ট করবে তখন উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে যে এই মহাপ্রকল্পের তহবিল কোত্থেকে আসবে।
জার্নালের খবর মতে, নিওমের সাবেক কর্মচারীরা এবং এ প্রকল্প বিষয়ে ওয়াকিবহালরা জানেন না সম্ভাব্য তহবিল সমস্যা এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে এই মহাপরিকল্পনার কতটা বাস্তবায়িত হবে।
এ প্রকল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বরাত দিয়ে জার্নাল জানায়, মেগাসিটির পরিকল্পনা ও উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ের তহবিল বিদেশ থেকে আনা ঋণে মিটানো হয়েছে।
সৌদি আরবকে আধুনিকায়ন এবং জীবাশ্ম জ্বালানির উপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে দেশটির অর্থনীতিকে বহুমুখী করার যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ভিশন ২০৩০-এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে নিওম মহাপ্রকল্প। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহর থেকেও প্রায় ৩৩ গুণ বড় হবে ওই মেগাসিটি। ২০৩০ সালের মধ্যে আলোচিত ওই মেগাসিটি নির্মাণকাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে দেশটি এ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
ভিশন-২০৩০-এ যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে, তার অংশ হিসেবে ৫০ হাজার কোটি ডলার বা প্রায় ৪০ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সাড়ে ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত একটি মহানগর তৈরির পরিকল্পনা করছে সৌদি সরকার, যা মিসর ও জর্দান সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের মতে, এটা হবে গোটা বিশ্বের প্রযুক্তি গবেষণার রাজধানী, উদারনৈতিক সামাজিক ব্যবস্থা, ট্রাফিক জ্যামহীন, টেকসই শক্তিচালিত এক উত্তরাধুনিক শহর। এর জন্য প্রস্তাবিত বিনিয়োগ ধরা হয়েছে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার। এই প্রজেক্টের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার সময়সীমা ধরা হয়েছে ২০২৫ সাল। এ ছাড়াও প্রায় ৮০টি বৃহৎ প্রজেক্টের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যা শেষ করা হবে ২০৩০ সালের ভেতর। এ ছাড়া ভিশন-২০৩০-এর আওতায় একটি পর্যটন প্রকল্প শুরু করেছে সৌদি আরব। এর আওতায় রয়েছে ১০০ মাইল দীর্ঘ বালুকাময় উপকূল ও ৫০টি দ্বীপের একটি উপহ্রদ। সব মিলিয়ে সৌদিতে ভিশন-২০৩০ মানে এক বিরাট কর্মযজ্ঞ, যা পাল্টে দিতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটির পুরো অর্থনৈতিক চেহারাই।
ওই মেগাসিটি নির্মাণের পর দেশটিতে নতুন করে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তেলনির্ভর অর্থনীতির এদেশে অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্য দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের জন্য ‘ডিসকোভারনিয়ম’ নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে, যেখানে তুলে ধরা হয়েছে নতুন মেগাসিটির বিস্তারিত বিবরণ। ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে, এটি হবে এমন এক শহর যেখানে এমন সব বিষয় থাকবে যা পৃথিবীর অন্য কোথাও (একসঙ্গে) নেই।
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এ মেগাসিটিতে ‘স্বপ্নের শহর’ বলে অভিহিত করেছেন। এখানে দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য থাকবে নজিরবিহীন সব ব্যবস্থা। বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলের এ মেগাসিটিতে পৃথিবীর সেরা থিয়েটার, শপিং মল তো থাকছেই। বিশ্বের সেরা সেরা স্টুডিও থাকবে নিয়ম সিটিতে। কর্তৃপক্ষ আশা করছেন, হলিউড থেকে শুরু করে বিশ্বের সেরা পরিচালকরা তাদের ফিল্মের কাজ করতে ছুটে আসবেন NEOM-এ। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও কোম্পানিগুলোর জন্যও নিওম হবে এক কাঙ্ক্ষিত ঠিকানা।
তথ্য-প্রযুক্তির সর্বশেষ নানা বিষয় নিয়ে গবেষণার জন্য উপযোগী ল্যাব ও প্রতিষ্ঠান থাকবে ওই সিটিতে। বিশেষ করে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ইত্যাদির ওপর উচ্চতর গবেষণার মাধ্যমে কিভাবে দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করা যায় তা নিয়ে কাজ করবেন গবেষকরা। ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ভবিষ্যত পৃথিবীর নতুন ধরনের নানা স্বাস্থসেবার যাত্রা শুরু হবে নিওম থেকে। বায়োটেকনোলজি গবেষণায় নতুন মাত্রা আনতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে, থাকবে একাধিক গবেষণাগার।
নিওম হবে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ কেন্দ্র। বিমান, স্থল ও জলপথে বিশ্বের নানা প্রান্তে যাতায়াতের জন্য ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার হবে এই লোহিত সাগরের তীরবর্তী এই শহর।
মরুভূমিতে পানির সংকট। আর পৃথিবীবাসী আগামীতে জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে চায়। এদিকে সৌদি আরবের তেলের রিজার্ভও ফুরিয়ে আসছে। এমতাবস্থায় নিওম সিটি কাজ করবে সৌর বিদ্যুতের উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়ানোর জন্য। একই সঙ্গে বিশুদ্ধ পানির চাহিদা মেটাতে থাকবে নানা প্রকল্প।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০২
আপনার মতামত জানানঃ