মহামারির মতোই ভয়ানক হয়ে উঠেছে সড়ক দুর্ঘটনা। দেশে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হচ্ছে, নিহত হচ্ছে। করোনাকালীন সময়ে মানুষের চলাচলে কিছু সীমাবদ্ধতা আসলেও সড়ক দুর্ঘটনার হার থেমে নেই। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই দেশে ৪০৬টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫১৭ জন নিহত এবং ৬৫৯ জন আহত হয়েছেন। নিহতের মধ্যে ৯৭ জন নারী এবং ৬৮টি শিশু রয়েছেন। আজ বুধবার (০৩ মার্চ) রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এ পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। দেশের ৭টি জাতীয় দৈনিক, ৫টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
সংস্থাটি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ১৫৬টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১৭১ জন, যা মোট নিহতের ৩৩ দশমিক ০৭ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১২৭ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২৪ দমমিক ৫৬ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৭৬ জন, অর্থাৎ ১৪ দশমিক ৭০ শতাংশ।
এই সময়ে ৬টি নৌ-দুর্ঘটনায় ছয়জন নিহত এবং ৫৫ জন আহত হয়েছে। ১৩টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত এবং চারজন আহত হয়েছে।
সংস্থাটির দুর্ঘটনায় মোট নিহতের যানবাহনভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেল আরোহী ১৭১ জন (৩৩ দশমিক ০৭ শতাংশ), বাস যাত্রী ৬৬ জন (১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ), ট্রাক-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি যাত্রী ৩৭ জন (৭ দশমিক ১৫ শতাংশ), মাইক্রো-কার-অ্যাম্বুলেন্স যাত্রী ১৬ জন (৩ দশমিক ০৯ শতাংশ), থ্রি-হুইলার (সিএনজি-ইজিবাইক-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টমটম) ৭৪ জন (১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ), নসিমন-ভটভটি-বোরাক-পাখিভ্যান-চান্দের গাড়ি যাত্রী ১৪ জন (২ দশমিক ৭০ শতাংশ) এবং বাই-সাইকেল, প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান, পাওয়ারটিলার যাত্রী ও শ্রমিক ১২ জন (২ দশমিক ৩২ শতাংশ) নিহত হয়েছে।
নিজেদের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৩৮টি (৩৪ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, ১২২টি (৩০ দশমিক ০৪ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে, ৯৫টি (২৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ) গ্রামীণ সড়কে, ৪৪টি (১০ দশমিক ৮৩ শতাংশ) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৭টি (১ দশমিক ৭২ শতাংশ) দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনাসমূহের ৭৯টি (১৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৪২টি (৩৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১২৩টি (৩০ দশমিক ২৯ শতাংশ) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৪৯টি (১২ দশমিক ০৬ শতাংশ) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১৩টি (৩ দশমিক ২০ শতাংশ) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
সংগঠনটির পর্যবেক্ষণ বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেপরোয়াভাবে বাড়ছে। গত জানুয়ারি মাসে ৪২৭টি দুর্ঘটনায় ৪৮৪ জন নিহত হয়েছিল। গড়ে প্রতিদিন নিহত হয়েছিল ১৫.৬১ জন। ফেব্রুয়ারিতে প্রতিদিন নিহত হয়েছে গড়ে ১৮.৪৬ জন। এই হিসেবে ফেব্রুয়ারিতে প্রাণহানি বৃদ্ধির হার ১৮.২৬ শতাংশ।
তাছাড়া, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রায় সবার বয়স ১৩ থেকে ৪০ বয়সের মধ্যে। ৬টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬ জন যুবক নিহত হয়েছে, ২ জন গুরুতর আহত। অর্থাৎ প্রতিটি মোটরসাইকেলে ৩ জন করে আরোহী ছিল।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসের লক্ষ্যে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের শাস্তি নিশ্চিত করা প্রথম কাজ। ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স, হেলপারদের গাড়ি চালানো, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল—এসব বন্ধ করতে হবে। শুধু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালককেই যেন লাইসেন্স দেওয়া হয়, সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে। তারা বলেন, এ ক্ষেত্রে বিআরটিএর অসাধু কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। সরকারকে এটা উপলব্ধি করতে হবে যে এটা একটা গুরুতর জাতীয় সমস্যা। সরকারের পাশাপাশি পরিবহনমালিক, শ্রমিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও সচেষ্ট হতে হবে, যাত্রী সাধারণের সচেতনতাও বাড়াতে হবে।
তারা মনে করেন, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ভুয়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো বন্ধ করা হলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ উদ্যোগ নেই। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সমস্যা, জরুরি ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনাহীনতাও দুর্ঘটনা বাড়ার পেছনে দায়ী।
এদিকে আজ বুধবার (০৩ মার্চ) ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল ট্রাফিক বিভাগের ১০০ জন পুলিশ সদস্য ‘প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ’ কোর্স সম্পন্ন করায় প্রশিক্ষণার্থীদের মাঝে সনদপত্র বিতরণ করা হয়েছে।
সনদপত্র বিতরণকালে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, এই প্রশিক্ষণের ফলে সড়কে যে কোনো দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দিতে পারবে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। আমি বিশ্বাস করি- এই ট্রেনিংয়ের ফলে তারা আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। এছাড়া প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য আইসিআরসির দেয়া বিভিন্ন সরঞ্জাম সড়কে আহত ব্যক্তিদের সেবায় কাজে আসবে।
আইসিআরসির হেড অব অপারেশন ডেভিড মন্তেস বলেন, যেসব মানুষ বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় বা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন তাদের যথাসময়ে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা পাওয়া উচিত এবং প্রয়োজনে তাদেরকে নিকটস্থ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে নেয়া উচিত। আমরা বাংলাদেশে দুর্ঘটনার পরিস্থিতিতে দ্রুত সাড়া প্রদানকারীদের জন্য এ ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়মিতভাবে আয়োজন করে আসছি। প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা প্রদানের মাধ্যমে তারা যেন মানুষের জীবন রক্ষা করতে এবং বাঁচাতে সক্ষম হয় সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ