সেতু নির্মাণের প্রধানতম শর্ত হলো সংযোগ রাস্তা থাকতে হবে এবং একইসাথে লোকজনের যাতায়াতও থাকতে হবে। কিন্তু এসব মেনেই যে সব জায়গায় সেতু নির্মাণ হয় তেমনটিও নয়। যেখানে সেতু থাকার কথা সেখানে না দিয়ে সংশ্লিষ্টরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে অন্যস্থানে খামোখা সেতু দাঁড় করিয়ে দেবার ঘটনা দেশে অনেক। একইসাথে নামকেওয়াস্তে সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে কাজ শেষ করার আগে ধ্বসে পড়ার ঘটনাও প্রায়ই আসে। সেতু নিয়ে দেশের ভিন্ন স্থানে তেমনি দুটি ঘটনা ঘটেছে।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়নের বলভা গ্রামে যেখানে সেতুর প্রয়োজন সেখানে না দিয়ে অন্যস্থানে নির্মাণ করা হয়েছে যেখানে কোনো সংযোগ সড়ক নেই। আরেকটি ঘটনা শোনা গেলো সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর সড়কের কোন্দানালা খালের ওপর নির্মিত সেতুটি সোমবার (১ মার্চ) ভোর রাতে ভেঙে পড়েছে। নির্মাণ কাজ শেষে হওয়ার আগেই ভেঙে পড়েছে সেতুটি। নিম্মমানের কাজের কারণে সেতুটি ভেঙে পড়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার ঘটনায় সংবাদ মাধ্যম মারফত জানা যায়, সেতুটির প্রয়োজন ছিলো শরিফুল ইসলামের বাড়ি থেকে নাসির উদ্দিনের বাড়ির মাঝখানে উলশি খালের ওপর। কিন্তু সেতু নির্মাণ করা হয়েছে আব্দুস সোবাহান ও আবুলের বাড়ির মাঝে। আর নাম ফলকে লেখা রয়েছে, বলভা দক্ষিণপাড়া মালেকের বাড়ি হতে বাবলুর বাড়ির মাঝখানে উলশি খালের ওপর। সেতুটির দু’পাশে কোন সংযোগ সড়ক নেই। স্থানীয়রা সেতুর ওপর গরুর গোবর ও ভেজা কাপড় রোদে শুকানোর জন্য ব্যবহার করছে।
স্থানীয়রা বলেন, ‘সেতুটি নির্মাণ করার সময় তারা বাধা দিয়েছেন। কিন্তু তা উপেক্ষা করা হয়। সেই থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।’
তারা আরও বলেন, ‘শরিফুল ইসলামের বাড়ি থেকে নাসির উদ্দিনের বাড়ির মাঝখানে উলশি খালের ওপর ছোট একটি সেতুর অভাবে যুগযুগ ধরে তারা নৌকায় করে ও পানিতে ভিজে এপার-ওপার যাতায়াত করছেন।’
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্র জানায়, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দে সেতু/কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ২৪ লাখ ৬৮ হাজার ৯১৫ টাকা ব্যয়ে ৩০ ফুট দৈর্ঘ্যের এ সেতুটি নির্মাণ করা হয়।
সংবাদকর্মীরা সরেজমিনে গিয়ে দেখেন, সেতুর ওপরে গরুর গোবর শুকানো হচ্ছে। দু’পাশেও একইরকম অবস্থা।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. নূর মামুন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘২০১৫-১৬ অর্থ বছরে তিনি তাড়াশ উপজেলার দায়িত্বে ছিলেন না। শরিফুল ইসলামের বাড়ি থেকে নাসির উদ্দিনের বাড়ির মাঝখানে উলশি খালের ওপর আরেকটি সেতু নির্মাণ করে দেওয়া হবে।’
এদিকে সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর সড়কের কোন্দানালা খালের ওপর নির্মিত সেতুটি গার্ডার বসানোর সময় হাইড্রোলিক জ্যাক বিকল হয়ে সেতুটি ধ্বসে গেছে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে, বিকল্প সড়ক থাকায় ধ্বসের কারণে সড়কে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি বলে জানা যায়।
জানা যায়, দুটি প্যাকেজে পাগলা-জগন্নাথপুর-রানীগঞ্জ-আউসকান্দি আঞ্চলিক সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে মোট ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে সাতটি ব্রিজের নির্মাণ কাজ পেয়েছে এম এম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড। রবিবার রাতে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার ভাতগাঁও গ্রামের পাশে কুন্দানালা খালের নির্মাণাধীন সেতুতে গার্ডার লাগানোর সময় হাইড্রোলিক জ্যাকের তার ফেটে প্রথমে একটি গার্ডার ধ্বসে যায়। পরে সেতুতে থাকা সবগুলো গার্ডার বিকট শব্দ করে খালে দেবে যায়।
নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় সেতুর ৫টি গার্ডার ভেঙে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রায় দুই বছর থেকে সেতুটির নির্মাণ কাজ চলছে। প্রতিদিন ৩০-৪০জন শ্রমিক ব্রিজের কাজ করে যাচ্ছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নিম্নমানের কাজ করায় এমনটি হয়েছে। ভাতগাঁও গ্রামের শিব্বির আহমেদ বলেন, রাতে আমরা সেতু এলাকায় বিকট শব্দ শুনতে পাই। তখন গ্রামের সবাই মিলে গিয়ে দেখি পুরো সেতু ভেঙে খালে পড়ে গেছে। এর মাত্র আধ ঘণ্টা আগে সেতুর কর্মরত শ্রমিকরা সাইট ছেড়ে চলে যান। না হলে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটতো।
সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, গার্ডার ধ্বসের ফল সেতুর মূল কাটামোর কোনরূপ ক্ষতি হয়নি। ধ্বসে যাওয়া গার্ডারগুলো ঠিকাদার তার নিজ খরচে অপসারণ করে নতুন করে করে গার্ডার বসিয়ে দিবেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেতু নির্মাণের জন্য ওপর মহল থেকে যে বাজেট নির্ধারণ করা হয় তা নিচের মহল হয়ে সেতুতে এসে এতটাই সংকুচিত হয়ে যায় যে তখন বাধ্য হয়েই দুর্বল ও কম উপাদান দিয়ে নামকাওয়াস্তে সেতু নির্মাণ করা হয়। অথচ সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজন উন্নত, টেকসই ও নির্ভেজাল উপাদান। সেতুকে মানুষসহ যানবাহন চলার উপযোগী করে তুলতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তা ভিন্ন। তাই ধ্বসের মতো ঘটনা ঘটে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজদের সুবিধামতো সেতু নির্মাণ করে থাকেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বাড়ির আশেপাশে এমনসব স্থানে সেতু দাঁড়িয়ে আছে যেখানে সেতু দেওয়ার কোনো কথাই নেই। অন্যদিকে সেতুর অভাবে একই এলাকায় লোকজন পারাপারে ভোগান্তি সয়ে যাচ্ছেন। তারা বলেন, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়নের বলভা গ্রামের সেতুটি অস্থানে কেন নির্মাণ করা হলো এবং কেনইবা সরকারের এত টাকা অপচয় করে গেলো শুধু শুধু এবিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। একইসাথে উপযুক্ত স্থানে সেতু নির্মাণ করে লোকজনের ভোগান্তি দূর করার দাবি জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫৫
আপনার মতামত জানানঃ