পার্বত্য চট্রগ্রাম ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন কর্তৃক ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া সত্তেও বেআইনী অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে মানবন্ধন করেছে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার ওয়াজ্ঞগ্দা ইউনিয়নে শিলছড়ি এলাকাবাসী। বিনা নোটিশে, কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ না দিয়ে গ্রামের একটি মারমা পরিবারের জমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্প তৈরি করছে উপজেলা প্রশাসন। অর্ধশতাধিক মারমা পরিবারের এই গ্রামে গড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে একাধিক বাঙালি পরিবারকে ঘর বরাদ্দ দেওয়ার কথা স্বীকার করেছে প্রশাসন।
১৮ ফেব্রুয়ারি বনফুল মহিলা ক্লাব চত্বরে মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী উলামং মারমা জানান, আমি শিলছড়ি বনফুল ক্লাব সংলগ্ন জমি ৫০ বছর ধরে ভোগদখল করে আসছি। জায়গাটা খাস জেনে আমি ১৯৯৮ সালে ২১ অক্টোবর রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক বরাবর বন্দোস্তির জন্য আবেদন করি। কিন্তু পার্বত্যাঞ্চলে বন্দোবস্ত কার্যক্রম বন্ধ থাকার ফলে এখনো এটা কার্যকর হয় নাই। এমতাবস্থায় সহানীয় উপজেলা প্রশাসন গত ১৮ জানুয়ারি আমার দখলে থাকা ভূমিতে বালু ভরাটের কাজ শুরু করে। এখানে গৃহ তৈরি করে ভূমিহীনদের গৃহ নির্মাণ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
ইতোমধ্যে উলামং মারমা আইনজীবী আদনান রফিকের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, রাঙামাটির জেলা প্রশাসক, রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন। এসব কিছু তোয়াক্কা না করে স্থানীয় প্রশাসন ঘর নির্মাণের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে।
কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনতাসির জাহানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সরকারের খাসজমিতে ভূমিহীন এবং গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণের অংশ হিসেবে সেখানে এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। এটি সরকারের খাসজমি। জমিটি এখনও কারও নামে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়নি, খাসজমির জন্য যে কেউ আবেদন করতে পারেন, যদি সরকার বন্দোবস্ত না দেয়, তাহলে সেটা কারও নামে হতে পারে না।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদও অভিন্ন বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, দুটি পরিবারের জন্য মাত্র দুই শতক করে চার শতক জমি নেওয়া হয়েছে। পুরো জমিটাই খাস। তবে তিনি স্বীকার করেন, পার্বত্য এলাকায় কাউকে খাসজমি বন্দোবস্ত দেওয়ার সুযোগ নেই।
মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা বলেন, সমতলে খাসজমি বলতে যা বোঝায়, পাহাড়ে তা একই অর্থে ব্যবহূত হবে না। পার্বত্য প্রথাগত ভূমি আইন অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামের সব ভূমিই তাহলে তথাকথিত খাসজমি। প্রকৃতপক্ষে কাপ্তাইয়ের শিলছড়ি গ্রামে যার ভোগদখলীয় জমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্প করা হচ্ছে, তার অসম্মতিতে, তাকে কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়ে এটা করা উচিত হবে না।
উল্লেখ্য, পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি ও উন্নয়নের লক্ষ্য ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই হয়। চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০০১ সালের ২০ জুন সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে চেয়ারম্যান করে গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন। তবে এই কমিশন আইনের কিছু ধারা সাংঘর্ষিক হওয়ায় সেসব সংশোধন করে ২০১৬ সালে পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৬ সংসদে পাস হয়। কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ভূমিবিরোধ রয়েছে তার নিষ্পত্তির লক্ষ্যে কাজ করবে। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ অধ্যাদেশ ১৯৫৮ মোতাবেক কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ না দিয়ে অধিগ্রহণ আইনত অবৈধ। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত কোনো পূর্ণাঙ্গ জরিপ হয়নি বলে জনগণের সব জমিই খাস হিসেবে বিবেচিত হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গত তিন দশক ধরে ঐ অঞ্চলে আদিবাসী কমছে আর বাঙালিদের সংখ্যা বাড়ছে৷ পাহাড়িরা হারিয়েছে ভূমি-বনাঞ্চল আর আমদানি করা সেটলার বাঙালিরা দুর্বৃত্ত আমলা প্রশাসনের যোগসাজশে তা দখল করেছে। আদিবসীদের ভূমি যাতে কেউ তাদের ঠকিয়ে না নিতে পারে, সেজন্য আইন আছে৷ কিন্তু সেই আইনে তাদের জমি রক্ষা পাচ্ছে না৷ সুতরাং, উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনের কাছে প্রত্যাশা পাহাড়িদের উচ্ছেদ, এবং প্রতিনিয়ত তাদের ভূমি হারানোর বিষয়গুলো আন্তরিকভাবে তদন্ত করে, দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং উচ্ছেদ হওয়া পাহাড়ি পরিবারগুলিকে তাদের হারানো বাড়িঘর ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৪১৪
আপনার মতামত জানানঃ