করোনার টিকা নিয়ে কৌশলগত ভ্রান্তির কথা স্বীকার করেছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লিয়ন। টিকাদানের অতি মন্থরগতি নিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ইইউভুক্ত বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমগুলোয় তীব্র সমালোচনা চলছে। প্রবল সমালোচনার মুখে ইইউ কমিশন একগুচ্ছ নতুন পদক্ষেপের ঘোষণা করেছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেবার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে।
ইসরায়েল, অ্যামেরিকা থেকে শুরু করে এমনকি সদ্য ইইউ ত্যাগ করা দেশ ব্রিটেনেও মানুষকেও দ্রুত গতিতে করোনার টিকা দেয়া হচ্ছে। অথচ বিশাল রাষ্ট্রজোট হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে টিকার সরবরাহ ও বণ্টনের ক্ষেত্রে পদে পদে সমস্যা দেখা যাচ্ছে। অথচ টিকা কেনা ও বণ্টনের ক্ষেত্রে দক্ষতার আশা করে এই প্রথম ইইউ কমিশনকে এমন গুরুদায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। সেই দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছে ইইউ কমিশন প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েনের বিরুদ্ধে।
এর আগে ১০ ফেব্রুয়ারি ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেইন বলেন, আমরা ইউরোপীয়রা সম্মিলিতভাবে ভ্যাকসিন অর্ডার দিয়েছিলাম। আমি ভাবতেও পারি নি যে, বড় বড় সদস্য দেশগুলি সমস্ত ভ্যাকসিন নিয়ে নেবে আর অন্য সবাইকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এরকম যদি হয়, তাহলে আমাদের ইউরোপীয় বাজার এবং ইউরোপের সব দেশের মধ্যে একতা কোথায়?
অনেক দেরি করে এবং যথেষ্ট পরিমাণ টিকা অর্ডার না দেওয়ার কারণে বছরের প্রথম তিন মাসে ইইউ দেশগুলিতে এমনকি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের জন্যও যথেষ্ট পরিমাণ টিকার ব্যবস্থা করা যায় নি বলে সমালোচনা শোনা যাচ্ছে৷ এমন বিলম্বের ফলে করোনা ভাইরাসের আরও ছোঁয়াচে সংস্করণগুলি পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে৷
জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েন্স স্পান বলেছেন, মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে জার্মানিতে ব্রিটিশ ভেরিয়েন্টের প্রসার ছয় থেকে ২২ শতাংশ ছুঁয়েছে৷ প্রবল চাপের মুখে ইইউ কমিশন বুধবার করোনা সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে আরও কিছু পদক্ষেপের ঘোষণা করছে৷ এই উদ্যোগের আওতায় টিকা অনুমোদনের গতি আরও বাড়ানো, আরও কার্যকরভাবে করোনার ছোঁয়াচে সংস্করণগুলির মোকাবিলা এবং বাড়তি কয়েক কোটি টিকা কেনা হবে৷
কমিশনের প্রেসিডেন্ট ফন ডেয়ার লাইয়েন বলেন, এখনো পর্যন্ত ইইউ দেশগুলিতে তিন কোটি তিরিশ লাখ টিকা সরবরাহ করা হয়েছে৷ এখনো পর্যন্ত শুধু জাতীয় স্তরে জরুরি ভিত্তিতে টিকা অনুমোদনের সুযোগ থাকায় ইইউ স্তরে করোনা টিকা অনুমোদনের কাজে বাড়তি সময় লেগেছে৷ নতুন আইন প্রণয়ন করে ভবিষ্যতে ইইউ-কেও সেই ক্ষমতা দেবার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি৷
এক সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফলে চলমান সংকটের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির এক ভয়াবহ খতিয়ান তুলে ধরা হয়েছে৷ সেই রিপোর্ট অনুযায়ী টিকাদান কর্মসূচি যথেষ্ট দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলে চলতি বছরে ক্ষতির মাত্রা ৯,০০০ কোটি ইউরো পর্যন্ত ছুঁতে পারে৷ আলিয়ানৎস বিমা কোম্পানি ও অয়লার হ্যার্মেস ঋণ বিমা কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে এমন পূর্বাভাষ দেওয়া হয়েছে৷ সেই গবেষণা অনুযায়ী টিকাদানে যত বিলম্ব হবে, অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রা ততই বাড়বে৷ টিকাদানের বর্তমান হারে গতি আনতে না পারলে ২০২২ সাল পর্যন্ত জনজীবন স্বাভাবিক হবে না৷
ব্রিটেন, দক্ষিণ আফ্রিকা বা ব্রাজিলের মতো দেশ থেকে আসা আরও ছোঁয়াচে ভেরিয়েন্ট বা সংস্করণ শনাক্ত করতেও ইইউ বাড়তি উদ্যোগ নিচ্ছে। করোনা পরীক্ষার ইতিবাচক ফলের নমুনার কমপক্ষে পাঁচ শতাংশ পরীক্ষা করার আবেদন জানিয়েছে ব্রাসেলস। নতুন সংস্করণ সরাসরি শনাক্ত করতে পরীক্ষা পদ্ধতি তৈরি করতে জন্য ইইউ সাড়ে সাত কোটি ইউরো অনুদান দিচ্ছে। অ্যামেরিকার মডার্না কোম্পানির কাছে ইইউ আরও ৩০ কোটি টিকার অর্ডার দিয়েছে। এর অর্ধেক চলতি বছর এবং বাকিটা আগামী বছর হাতে পাওয়ার কথা। বায়োনটেক-ফাইজারও ইইউ-কে বাড়তি ২০ কোটি টিকা সরবরাহ করবে। ফলে ইইউ প্রায় ৪৫ কোটি জনসংখ্যার জন্য সব মিলিয়ে মোট ২৬০ কোটি টিকার অর্ডার দিলো। বাড়তি টিকা অন্যান্য দেশগুলিকে দিতে চায় ইইউ।
টিকাদান কর্মসূচির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রাও স্থির করেছে ইইউ। আগামী ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইইউ দেশগুলির ৭০ শতাংশ মানুষ টিকা পেয়ে যাবেন বলে আশ্বাস দিয়েছে কমিশন। তবে এখনো পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি অত্যন্ত কম বলে স্বীকার করেছেন প্রেসিডেন্ট ফন ডেয়ার লাইয়েন। ঘাটতি মেটাতে বছরের চতুর্থ মাস থেকে টিকা সরবরাহ বাড়বে বলে আশা করছেন তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/২২০৫
আপনার মতামত জানানঃ