বানিয়াচংয়ের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা কৃষক লীগের সভাপতি হুমায়ুন কবীর রেজার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি ভূমিতে অনধিকার প্রবেশ, ভূমিহীনদের নামে বন্দোবস্ত দেওয়া সরকারি খাস ভূমি প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ, ওই ভূমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি, গাছ কেটে বিক্রি, মাছ বিক্রিসহ সর্বমোট তিন কোটি ৩২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা সরকারি রাজস্ব আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। এবিষয়ে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করেছে স্থানীয় ভূমি অফিস। জেলা প্রশাসনের নির্দেশে উপজেলার খাগাউড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর্মকর্তা দিদার হোসেন সম্প্রতি বানিয়াচং থানায় মামলাটি করেন।
বানিয়াচং উপজেলার ১১ নম্বর মক্রমপুর ইউনিয়নের সুলতানপুর মৌজার বিভিন্ন দাগে মোট ১৪ একর ৪৫ শতক ভূমি ১৯৮৮ সালে এলাকার ভূমিহীনদের নামে লিজ দেয় বানিয়াচং উপজেলা ভূমি অফিস। কিন্তু লিজ দেওয়ার পর এ জমিতে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ না করে পতিত ফেলে রাখেন ভূমিহীনরা। এলাকার নিরীহ ভূমিহীনদের নানা প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে পুরো ভূমিসহ কাগজপত্র নিয়ে নেন হুমায়ুন কবীর রেজা।
জানা যায়, হুমায়ুন কবীর রেজার ছোট ভাই মরহুম সামায়ুন কবীরের নামে সামায়ুন কবীর হাফিজিয়া মাদ্রাসা নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ওই মাদ্রাসার জন্য আরেকটি নতুন ভবন গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছেন তিনি। অন্যদিকে, পুকুরের দক্ষিণ অংশে মাছচাষ ও পাড়ে রোপণ করা নানা জাতের গাছ বিক্রি করে হুমায়ুন কবীর রেজা হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। আংশিক জায়গায় মাদ্রাসা নির্মাণ করে পুরো ১৪ একর জমি দখল করে রেখেছেন জেলা কৃষক লীগ সভাপতি হুমায়ুন কবীর রেজা।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ১৯৮৮-৮৯ সালে উপজেলার সুলতানপুর মৌজার ১৮ একর ৮৮ শতাংশ জমি ১৭ জন ভূমিহীনের নামে বন্দোবস্ত দেয় সরকার। কিন্তু তাদের সরিয়ে ওই জমি দখল করেন হুমায়ুন কবীর রেজা। সরকারি অনুমতি না নিয়েই তিনি দখল করা জমির গাছ কেটে ও মাছ বিক্রি করে অর্থ লোপাট করে আসছিলেন। সরকারি জমি দখল করে তিনি ফসলের ক্ষেতও তৈরি করেন। দখল টিকিয়ে রাখার কৌশল হিসেবে ওই জমিতে তিনি মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ করেন।
অভিযোগের বিবরণীতে বলা হয়, সরকারি বনায়নের ৫০টি গাছ বিক্রি করে দুই লাখ টাকা এবং সরকারি জমিতে ৫ ফুট গর্ত করে মাটি বিক্রি করে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। বিশাল পুকুর খনন করে তিনি মাছ চাষ করেন। ১০ বছরে সেখান থেকে দুই কোটি টাকার মাছ বিক্রি করা হয়। এছাড়া, সরকারি ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন ও বনায়ন ধ্বংস করে অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করেন হুমায়ুন কবীর।
এ বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীন পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে গত ২১ ডিসেম্বর বানিয়াচংয়ের সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর লিখিত অভিযোগ করা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পায় স্থানীয় ভূমি অফিস।
এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি জেলা প্রশাসককে অবহিত করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)। ১০ ফেব্রুয়ারি অভিযুক্ত হুমায়ুন কবীর রেজার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান। এরপরই তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
ইউএনও মাসুদ রানা বলেন, ‘হুমায়ূন কবীর রেজা ভূমিহীনদের জায়গা দখল করে বিপুল পরিমাণ সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছেন। স্থানীয় ভূমিহীনদের অভিযোগের ভিত্তিতে একাধিকবার সরেজমিন তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। পরে জেলা প্রশাসনের নির্দেশে মামলা দায়ের করা হয়।’
তবে জেলা কৃষক লীগ সভাপতি হুমায়ুন কবীর রেজার দাবি, ‘এসব অভিযোগ ভুয়া। দরখাস্তে অভিযোগকারীর নাম আছে কিন্তু ঠিকানা নেই। এটি নিয়ে হাইকোর্টে মামলাও আছে। তদন্ত হয়েছে। তদন্তে তারা যা পেয়েছেন তাই দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘জমির মালিক ভূমিহীনরাই আছে। আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এটি সাজানো। একতরফাভাবে করা হয়েছে। আমার কোনো কথা শোনা হয়নি। আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এটি করিয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সরকারি জমি দখলে নেওয়ার রীতি রয়েছে। সরকারদলীয় রাজনীতিবিদ হলে সরকারি সম্পত্তিকে নিজের বলেই মনে করেন স্থানীয় সরকারদলীয় নেতারা। তার ওপর চেয়ারম্যান হলে উক্ত সম্পত্তি এমনিতেই নিজের মনে করাটা স্বাভাবিকভাবেই দেখে থাকেন তারা। স্থানীয়ভাবে ক্ষমতাশালী ও রাজনৈতিক পদপ্রাপ্ত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে কেউ সাহস পান না। এই সুযোগটাকেই তারা কাজে লাগিয়ে থাকেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা জানান, মাদ্রাসা মসজিদ দিয়ে সরকারি জমি দখল স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতাশালীদের পুরনো কৌশল। তারা মনে করেন সরকারি জমিতে মাদ্রাসা মসজিদ নির্মাণ করলে সরকারের পক্ষ থেকে যেমন কোনো বাঁধা আসবে না তেমনি সমর্থন থাকবে স্থানীয়দেরও। এসবের সুযোগ নিয়ে তারা অবৈধভাবে সম্পত্তি দখল ও নিজেদের পকেট ভারী করেন বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩২
আপনার মতামত জানানঃ