মহামারি করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন বণ্টন প্রক্রিয়া নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস। বিশ্বের ধনী ১০ রাষ্ট্র ভ্যাকসিনের ৭৫ শতাংশই কব্জা করেছেন যার বিপরীতে এখনো ১৩০টি দেশ ভ্যাকসিনের ছোঁয়াও পায়নি। আর এই বণ্টন প্রক্রিয়াকে তিনি ‘চরম অসম ও অন্যায্য’ বলে উল্লেখ করেছেন। গতকাল বুধবার(১৭ ফেব্রুয়ারি) জাতিসংঘের সেক্রেটারি কাউন্সিলের শীর্ষ পর্যায়ের একটি বৈঠকে গুতেরেস এসব কথা জানান। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব বলেন, ‘এই কঠিন মূহূর্তে ভ্যাকসিন সমতাই বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।’
বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর জন্য টিকা নিশ্চিত করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গঠন করা কোভ্যাক্স কর্মসূচি ইতোমধ্যে প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে একই সময়ে ধনী দেশগুলো টিকাদান শুরু করতে সক্ষম হয়েছে। বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশ ইতোমধ্যে কোভ্যাক্স কর্মসূচির টিকার জন্য অপেক্ষা না করেই তা কেনার জন্য প্রাইভেট চুক্তি স্বাক্ষর করতে ছুটছে।
সকল দেশে ভ্যাকসিনের ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিতের জন্য সংশ্লিষ্টদের নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে একটি বৈশ্বিক ভ্যাকসিন প্রয়োগ পরিকল্পনার আহ্বান জানিয়েছেন গুতেরেস। এতে বিজ্ঞানী, ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও অর্থ প্রদানকারীরা অন্তর্ভুক্ত থাকবেন।
এছাড়া জি-২০ জোটের বিশ্বের শীর্ষ অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশগুলোর প্রতি একটি জরুরি টাস্ক ফোর্স গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। এই টাস্ক ফোর্স ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি, গুরুতপূর্ণ শিল্প ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে একত্রিত করবে।
গত শুক্রবার এক বৈঠকে গুতেরেস বলেছিলেন, শীর্ষ ৭ অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশের জোট জি-৭ প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক যোগানের উৎসগুলোকে একত্রিত করতে পারে।
গত মঙ্গলবার মেক্সিকোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারসেলো এবরার্দ জানান, নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে মেক্সিকো সকল দেশের জন্য ভ্যাকসিনের সম বণ্টনের ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করবেন।
তিনি সমালোচনা করে বলেন, যেসব দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হচ্ছে সেসব দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগের হার অনেক বেশি, অথচ দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো ভ্যাকসিন পেতে হিমশিম খাচ্ছে।
করোনাকে বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণার পরপর ভ্যাকসিন পেতে উঠেপড়ে লাগে কয়েকটি দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পই অধিকাংশ ভ্যাকসিন নিজের দেশের জন্য অগ্রিম কিনে নেয়ার চেষ্টা করেন। এরপর ব্রিটেন, ইতালি, স্পেন, ব্রাজিলও একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়।
এদিকে ভ্যাকসিন থেকে দরিদ্র দেশ বঞ্চিত হলে ক্ষতির মুখে পড়বে বিশ্ব অর্থনীতি। এতে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ধাক্কা উন্নয়শীল দেশগুলোর মতো উন্নত দেশগুলোতেও লাগবে বলে অতীতের কয়েকটি গবেষণা জানিয়েছিল। সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ধনী দেশগুলো তাদের শতভাগ নাগরিককে টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনতে পারবে। অথচ তখনো ভ্যাকসিনেশন থেকে অনেক দূরে থাকবে দরিদ্র দেশগুলো। এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি ৯ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হবে। এ অংকটি জাপান ও জার্মানির সম্মিলিত বার্ষিক জিডিপির চেয়েও বড়। তবে এ ক্ষতিতে এখানে অর্ধেকের বেশি মূল্য চুকাতে হবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ব্রিটেনের মতো ধনী দেশগুলোকে।
গবেষকরা যেটিকে বলছেন ‘খুব সম্ভাব্য’ সেই চিত্রটি বলছে, বছর শেষে উন্নয়নশীল দেশগুলো হয়তো তাদের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিন দিতে পারবে। তখন বিশ্ব অর্থনীতিকে ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন থেকে ৩ দশমিক ৮ ট্রিলিয়নের ধাক্কা সামলাতে হবে। এক্ষেত্রেও ধনী দেশগুলোকে অর্ধেকের বেশি ক্ষতি বহন করতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের সহায়তায় পরিচালিত গবেষণাটি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, ভ্যাকসিনের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন সব দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য জরুরি, বিশেষ করে সেসব দেশ, যারা বাণিজ্যের ওপর অধিক নির্ভর করে। পাশাপাশি এটি সেই ধারণাটির সমালোচনা করে যেখানে বলা হয়, ভ্যাকসিন ভাগাভাগি করা মানে দরিদ্র দেশকে সহায়তা করা।
এ গবেষণাটির একজন গবেষক সেলভা ডেমিরালপ বলেন, স্পষ্টত সব অর্থনীতি একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত। অন্য অর্থনীতিগুলোর পুনরুদ্ধার করা ছাড়া কোনো অর্থনীতিই পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
উন্নয়নশীল দেশগুলো ভাইরাসের বিস্তার থামানোর লক্ষ্যে লকডাউনের কারণে যদি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে থেকে যায়, তখন তাদের হাতে খরচ করার জন্য খুব সামান্য অর্থই থাকবে। যে কারণে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার রফতানিকারকদের বিক্রি হ্রাস পাবে। পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকেও ব্যাপকভাবে সংকটে পড়তে হবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুনাফার আগে মানুষের জীবন নিয়ে ভাবতে হবে। কার পকেটে কত টাকা রয়েছে, তাই যদি জীবনরক্ষাকারী ভ্যাকসিন ব্যবহারের মানদণ্ড হয়, তবে পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ এই মহামারি প্রতিরোধে টিকা নিতে অসমর্থ হবে। তারা বলেন, বিজ্ঞানের অর্জন যেন মানুষের জীবনরক্ষাকারী না হয়ে শুধু ওষুধ কোম্পানিগুলোর মুনাফা অর্জনের পথ না হয়। তারা বলেন, এই মহামারিটি একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা, যার একটি বৈশ্বিক সমাধান প্রয়োজন। আর যতক্ষণ না পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের এই ভ্যাকসিন নেওয়ার সামর্থ্য রইবে না, ততক্ষণ বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৫
আপনার মতামত জানানঃ