১১ ফেব্রুয়ারী বুধবার জনপ্রিয় সাংবাদিক টিম সেবাস্টিয়ানের উপস্থাপনায় ডয়চে ভেলেতে প্রচারিত টক শো ‘কনফ্লিক্ট জোন’-এ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। আল জাজিরায় প্রচারিত ডকুমেন্টারি ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। স্টেটওয়াচ এর পক্ষ থেকে দুইজনের কথোপকথন বাংলায় প্রকাশ করা হল।
টিম সেবাস্টিনয়ান : বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ সরকার মানবাধিকার সংরক্ষণের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে কিন্তু এই মাসে প্রকাশিত আল জাজিরার প্রতিবেদনে উচ্চ পর্যায়ের ঘুষ এবং দুর্নীতি অভিযোগ নতুন মাত্রা হিসেবে যুক্ত হয়েছে। এই সপ্তাহে আমার অতিথি হলেন ঢাকা থেকে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভি। কবে সরকার তাদের বিরুদ্ধে আসা নিপীড়নের বিষয় অস্বীকার করা বন্ধ করবে এবং নিজেদের পরিবর্তন করবে?
গওহর রিজভী, কনফ্লিক্ট জোনে আপনাকে স্বাগতম।
গওহর রিজভী : ধন্যবাদ।
সেবাস্টিয়ান : আপনার দেশ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণে পরিণত হয়েছে যা সরকার বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে যার কাজ সত্যের সাথে কাজ করা, কেন আপনি এরকম একটা সরকারের সাথে কাজ করছেন যাদের মানবাধিকারের প্রতি নূন্যতম সম্মান নাই।
রিজভী : জনাব সেবাস্টিন, আমি মনে করি এই প্রশ্নটা কিছুটা পরিবর্তিত হওয়া দরকার। যখন আপনি বলেন মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন, আমি ব্যাখ্যা করতে চাই যে মানবাধিকার একটি বৃহৎ শব্দ।
সেবাস্টিয়ান : আমি আরও স্পষ্ট করে দিচ্ছি। অবৈধ আটক, জোরপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের; এই সকল অভিযোগ আপনার সরকারের বিরুদ্ধে এসেছে এশিয়ার জাতিসংঘ মানাধিকার সংস্থাসমূহ, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের নিপীড়ন বিরোধী কমিটির পক্ষ থেকে এসেছে। আমি এগুলোই বোঝাতে চেয়েছি।
আমি অস্বীকার করবো না যে কিছু গুমের উদাহরণ এখানে নাই। কিন্তু যখন আপনি নির্যাতনের ব্যাপারে বলেন, আমার জানামতে নির্যাতনের ব্যাপারে কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। – গওহর রিজভী
রিজভী : আমি সমষ্টিগতভাবে অভিযোগগুলো মেনে নিতে পারতাম। আমি অস্বীকার করবো না যে কিছু গুমের উদাহরণ এখানে নাই। কিন্তু যখন আপনি নির্যাতনের ব্যাপারে বলেন, আমার জানামতে নির্যাতনের ব্যাপারে কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই।
সেবাস্টিয়ান : কিন্তু জাতিংসংঘের নিপীড়নবিরোধী কমিটি নিশ্চিত যে নিয়মিতভাবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পেয়েছে, সেই রিপোর্ট তারা একের পর পর প্রকাশ করেছে এবং আপনি আমাদের বিশ্বাস করতে বলছেন যে তারা সবটাই ভুল জেনেছে?
রিজভী : না, আমি অস্বীকার করছি না এবং আমি বলবো না যে তারা সবটাই ভুল জেনেছে। কিন্তু আমি এটাও বলতে চাই যে, সরকারের মতে নির্যাতন বেআইনি এবং আমরা চেষ্টা করি যাতে নির্যাতনের ঘটনা না ঘটে। যে কারনে আপনার প্রশ্নের ধরনে আমি আপত্তি জানিয়েছি। সেবাস্টিন তার কারন হল প্রচুর ভাল বিষয় বাংলাদেশে হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়নের সফলতায় একটি মূর্ত প্রতীক।
সেবাস্টিয়ান : হ্যাঁ এবং দেশের উদাহরণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রচারে আপনি খুব দক্ষ। কিন্তু সে ব্যাপারে আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি না। আমি জিজ্ঞেস যেসকল সমস্যাগুলো আপনার দেশে হয়েছে। আপনার সরকার দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্সের ব্যাপারে উল্লেখ করে। তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান দুর্নীতি বিরোধীর ব্যাপ্তিকে চুনোপুঁটি ধরা এবং দুর্নীতিবাজ বড় নেতাদের কার্যক্রম আমাদের ধারনার বাইরে বলে উল্লেখ করেছেন। সে বলেছে , আমরা কোন বড় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জোরদার তদন্ত বা কার্যকর আইন তৎপরতা দেখছি না। এই কি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স?
রিজভী : যদি আপনি মনে করেন ছয় থেক নয় মাস আগে বড় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিলো বিভিন্ন বড় দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং পুলিশী তদন্ত করা হচ্ছে এবং দুর্নীতি দমন কমিশনও তদন্ত করছে এটা নিয়ে। কিন্তু দিনশেষে আমাদের একটি বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরন করতে হয় এবং এটা একটা সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। আমি বলছি না যে আমাদের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ নির্ভুল, আমি এও বলছি না যে এখানে কখনো রাজনৈতিক বিবেচনা আসে না। এসব বিষয় সত্যি। জনাব সেবাস্টিন আপনি একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক, কিন্তু যেখানে আমি আপত্তি জানিয়েছি সেটা হল আপনি যেভাবে বিষয়টিকে চিত্রায়িত করেছেন সেটা একপাক্ষিক, এতে আপনার দর্শকেরা ভুলভাবে প্রভাবিত হতে পারে।
সেবাস্টিয়ান : চিত্রটা আমি তৈরি করছি না, আমি নির্ভর করছি হিউম্যান রাইট ওয়াচ, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, নিপীড়নবিরোধী কমিটির মত আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত সংস্থাসমূহের ওপর।
রিজভী : এই ক্ষেত্রে অনুগ্রহপূর্বক আমাকে বাস্তবতার ঘটনা দিয়ে বিষয়টিতে আলোচনার মাধ্যমে ভারসাম্য আনতে দিন।
সেবাস্টিয়ান : হ্যাঁ, সেটাই আপনি করছেন। কিন্তু এ সবকিছু সুপ্রশস্থ করেছে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিবেদনের যা এই মাসে আল জাজিরায় প্রকাশিত। যেখানে অভিযোগ এসেছে আপনার দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ব্যাপক দুর্নীতির মাত্রা সম্পর্কে এবং আপনার সরকারের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া ছিল প্রতিবেদনকে মিথ্যা কুৎসা এবং মানহানিকর আখ্যা দেয়া। আপনারা প্রথমে তদন্তের করার বিষয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামালেন না। এটা একটা দায়িত্বশীল সরকারের মত কাজ নয়, তাই নয় কি?
রিজভী : তদন্তের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তদন্ত করা হচ্ছে কিন্তু আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই যে প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল “অল দা প্রাইম মিনিস্টার’স মেন” এবং বলা হয়েছিলো যে এটা প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কিত দুর্নীতি প্রকাশ করবে। আপনি কি সত্যি বিশ্বাস করেন যে ওই প্রতিবেদন এটা করতে সক্ষম হয়েছে? দুর্নীতির অভিযোগের পক্ষে সেখানে কি মাত্র একটিও প্রমাণ ছিল যা প্রধানমন্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করেছে? এখানে আমি মনে করি একজন বিবেচক শিক্ষাবিদ এবং সাংবাদিক হিসেবে আমাদের সরে আসা উচিৎ এবং নিজেদের জিজ্ঞেস করা উচিৎ কি প্রমাণ দেয়া হয়েছে যা প্রধানমন্ত্রীর যুক্ত থাকাকে অভিযুক্ত করে? অথচ এই পুরো প্রতিবেদন সরকারের দুর্নীতিকে দেখানো হয়েছে বলে বানানো হয়েছে।
সেবাস্টিয়ান : আল জাজিরার প্রতিবেদনে একটি টিভি টিম বিচার থেকে পলাতক দুজন বড় মাপের খুনিকে খুঁজে বের করতে সফল হয়েছে যাদের বড় ভাই আপনাদের দায়িত্বরত সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। স্পষ্টতই আপনাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পলাতক ভাইদের খুঁজে পায় নি, কিন্তু আল জাজিরার টিভি টিম পেরেছে। এটা বেশ বিব্রতকর বিষয় আপনাদের জন্য, তাই না?
রিজভী : সত্যি হ্যাঁ, কিন্তু অন্যদিকে আবারো আমি সবকিছুর সমর্থনে বলবো না। কিন্তু যেভাবে আপনি আমাকে প্রশ্ন করছেন তাতে আমি এর প্রয়োজন অনুভব করছি। একজন ব্যক্তিকে কি তার ভাইয়ের অপরাধ দিয়ে দিয়ে বিচার করা উচিৎ? আমি মনে করি এই প্রশ্নটা আমাদের করা উচিৎ। এখন যদি সামরিক বাহিনীতে থাকা ভাই তার ভাইদের বিচার এড়ানোতে সহায়তা করে তাহলে এই অভিযোগ খুবই যৌক্তিক। যা হয়েছে তার অনেক অনেক আগে এই ভদ্রলোক আর্মি প্রধান হয়েছেন।
সেবাস্টিয়ান : আচ্ছা, ওইসব বিস্তারিত বিষয়ে লক্ষ্য করা যাক যা প্রতিবেদনে এসেছে জেনারেল আহমেদের ভাইদের ব্যাপারে। আনিস এবং হারিস অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে ১৯৯৬ সালে প্রতিপক্ষ দলের সদস্য খুনে যুক্ত থাকার। দুই ভাই বিচার এড়িয়ে পলাতক, তৃতীয় ভাই জোসেফও অভিযুক্ত এবং মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা অবস্থায় জেলে ১০ বছর অতিবাহিত করা অদ্ভুতভাবে তার ভাইয়ের আর্মি প্রধান হিসেবে পদোন্নতি লাভ করার পূর্বে জোসেফ রাষ্ট্রপতি ক্ষমা লাভ করে। এটা কিভাবে হল? বাংলাদেশ কি প্রমানিত খুনিকে মাফ করে দেয় যে প্রতিপক্ষকে প্রকাশ্যে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে? এটাই কি আপনারা করে থাকেন?
রিজভী : জনাব সেবাস্টিন যতটা নিশ্চয়তার সাথে আপনি কথাগুলো বলছেন তা আমাকে অবাক করছে এবং আপনি আর্মি প্রধানের নিয়োগ ও তার ভাইয়ের মুক্তিলাভকে একটি ঘটনায় যুক্ত করেছেন। আপনাকে মনে করিয়ে দেই……
সেবাস্টিয়ান : এটা একটি ঘটনাই বটে জনাব রিজভী।
রিজভী : না না না না, জনাব সেবাস্টিয়ান।
সেবাস্টিয়ান : আমার মূল কথা হচ্ছে একজন ঠাণ্ডা মাথার খুনিকে ক্ষমা পেতে অনেক বড় যোগাযোগ থাকতে হয়।
রিজভী : আমাকে তথ্যগুলো দিতে দিন, তারপর আপনি আপনার উপসংহার টানবেন। অনুগ্রহ করে আমাকে তথ্যগুলো দিতে দিন। যে ভাইকে নিয়ে প্রশ্ন, তিনি ২০ বছরের মত জেল খেটেছেন। দেশে এমন একটি আইন আছে যেখানে একটা নির্দিষ্ট সময় হাজতবাসের পরে রাষ্ট্রপতি কাউকে প্যারোলে বা ক্ষমা করে দিতে পারেন। যা হয়েছে তার সবকিছু এক ভাইয়ের আর্মি প্রধান হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তির অনেক মাস আগে হয়েছে। এসব সম্পূর্ণ আলাদাভাবে হয়েছে। এই মানুষটি সশস্ত্র বাহিনীতে ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিষ্কার ইতিহাসসহ কাজ করেছেন। তাহলে কেন আমরা দুষিত করছি এবং দুটি কাহিনী একত্রিত করছি। আমি দুটো ঘটনার সময়কালের দিকে দৃষ্টিপাত করতে চাই। এসবের মধ্যে ছয় মাসের ব্যবধান।
সেবাস্টিয়ান : আচ্ছা। ডঃ রিজভি আরেকটি বিষয় যা প্রতিবেদনে এসেছে তা হল আপনাদের সামরিক প্রধান খুব ভালোভাবেই জানতেন যে তার পলাতক দুই ভাই কোথায় ছিল এবং স্পষ্টতই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানায় নি। এটার তদন্ত কি প্রয়োজন ছিল না?
রিজভী : এটা তদন্ত করার মত হবে, কিন্তু আমি যা জানি আপনিও তাই জানেন। এই দুই ভদ্রলোক বাংলাদেশের জুরিসডিকশন এর বাইরে ছিলেন। তারপরও যদি তাদের তথ্য আমাদের কাছে থাকতো তাহলে ওই দুই দেশের সঙ্গে আমাদের এক্সট্রাডিশন চুক্তি থাকলে আমরা তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতাম। আসলে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তা করেছি এবং এটা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই যে আমরা তা করতাম না। আর আপনি খুব সত্যি যে যদি সরকারের কাছে এই তথ্য থাকতো তাহলে সরকার একশন নিত।
সেবাস্টিয়ান : আসলে এগুলো ক্ষমতার উপরের স্তরের অত্যন্ত কাছের ব্যাপার যা নিয়ে ঘাটাঘাটি অত্যন্ত বিপদজনক। এটা কি একটা ফ্যাক্টর নয় যে আপনার দেশের কেউই উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতির বিষয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করতে চায় না, চায় কি? অনেক বেশি মানুষ গুম হয়ে যায় এবং একপর্যায়ে প্রাণ হারায় যদি তারা ভুল কিছু বলে এবং ভুল প্রশ্ন করে, তাইনা? এটা আপনার দেশের একটা বাস্তবতা।
রিজভী : না না না, মিস্টার সেবাস্টিয়ান আমরা গর্বিত, সে আমরা যেভাবে অপূর্ণ থাকি না কেন। আমরা আমাদের মুক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে গর্বিত। আমরা গর্বিত যে আমাদের একজন প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন যিনি দুর্নীতি সহ্য করেন না। আমাদের সামরিক বাহিনী বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
সেবাস্টিয়ান : তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব যে, যে দেশে একটি কার্যকর বিচার ব্যবস্থা রয়েছে সে দেশে আপনার সেনাপ্রধানের দুই পলাতক ভাই; আনিস এবং হারিস জোড়া খুনের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ২০১৯ সালের ঢাকায় গিয়ে প্রকাশ্য একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন? এরকম নিশ্চয়ই অনেক পলাতক খুনী নেই যারা ক্ষমতাবানদের কোনরকম ছত্রছায়ায ছাড়াই উচ্চ পর্যায়ের এক বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারে এবং সেখানে রাষ্ট্রপতি ও বিদেশী বিশিষ্টজনদের সঙ্গে দেখা করতে পারে। আপনিও নিশ্চয়ই বিষয়টি আমার মত জানেন।
রিজভী : আমি…… আপনি একেবারে ঠিক। যদি এটা কেউ বুঝতে পারত যে এই ভদ্রলোকরা বাংলাদেশ ফিরেছেন তাহলে দ্রুত তাদের গ্রেফতার করা হতো। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ নেই।
সেবাস্টিয়ান : কিন্তু তাদের বিয়েতে যোগ দেয়ার ছবি রয়েছে। ডক্টর রিজভী, তাদের ছবি তোলা হয়েছিল। সেটা ছিল একটি সেনা ক্লাবে।দুজন দন্ডিত খুনি যারা কিনা পাত্রের চাচা, অন্য সবার সঙ্গে বিয়ের উৎসবে অংশ নিয়েছেন ।
আমরা বলছি যে এই দুজন বাংলাদেশে ফিরে এসেছে এবং তারা যদি সেটা করে থাকে মানে ছবিতে যা দেখা যাচ্ছে তাহলে সেটা আমাদের বিচার প্রশাসন এবং বিমানবন্দর পুলিশের একটি বড় ব্যর্থতা, এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে আপনার এটাও বুঝতে হবে যে, এই ব্যক্তিরা ভিন্ন নামের পাসপোর্ট জোগাড় করেছেন । সরকারের যদি সেটা জানা না থাকে এবং তারা যদি ওয়াচ লিস্টে না থাকে তাহলে তারা অন্য হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে মিশে ঢুকতে বা বের হতে পারবে। আমি একবারও বলছি না যে এটা সরকারের ব্যর্থতা নয়। এটা সরকারের একটি ব্যর্থতা । – গওহর রিজভী
রিজভী : আমরা এমন একটি ঘটনার কথা বলছি যা পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় আগে ঘটেছিল। এই দুইভাই ১৯৯৬ সালে অপরাধ করেছিল। সেটা জেনারেল আজিজ ক্যাডেট হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার অনেক আগের ঘটনা । এখন আমরা পঁচিশ বছর পরের ঘটনায় ফিরে আসি। আমরা বলছি যে এই দুজন বাংলাদেশে ফিরে এসেছে এবং তারা যদি সেটা করে থাকে মানে ছবিতে যা দেখা যাচ্ছে তাহলে সেটা আমাদের বিচার প্রশাসন এবং বিমানবন্দর পুলিশের একটি বড় ব্যর্থতা, এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে আপনার এটাও বুঝতে হবে যে, এই ব্যক্তিরা ভিন্ন নামের পাসপোর্ট জোগাড় করেছেন । সরকারের যদি সেটা জানা না থাকে এবং তারা যদি ওয়াচ লিস্টে না থাকে তাহলে তারা অন্য হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে মিশে ঢুকতে বা বের হতে পারবে। আমি একবারও বলছি না যে এটা সরকারের ব্যর্থতা নয়। এটা সরকারের একটি ব্যর্থতা ।
সেবাস্টিয়ান : ঠিক আছে। ডক্টর রিজভী, মুক্ত গণমাধ্যমসহ যে গণতন্ত্র বাংলাদেশের রয়েছে বলে আপনি দাবি করছেন তা সত্যি হলে আল-জাজিরার এসব অভিযোগ দেশটির পত্রিকা এবং টিভিতে প্রচার করা হতো। কিন্তু সেটা হয়নি, হয়েছে? ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকা এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছে “আমাদের নীরবতার কারণ” হিসেবে।পত্রিকাটি লিখেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বর্তমান পরিস্থিতি এবং মানহানি আইন এই বিতর্ক নিয়ে অর্থবহ মন্তব্য করা থেকে বাংলাদেশের সকল গণমাধ্যমকে দূরে রেখেছে। এটাই বাস্তবতা, তাই না? আপনি চাপ প্রয়োগ করে গণমাধ্যমকে নতি স্বীকার করতে এবং চুপ থাকতে বাধ্য করেছেন ফলে এটি এখন নিজের ছায়া দেখেই ভয় পেয়ে যাচ্ছে। আপনি কি এ জন্য গর্বিত?
রিজভী: আপনি যা বলেছেন তা যদি সত্যি হতো তাহলে আমি লজ্জিত হতাম। আপনি বরং আমাকে সত্যিটা বলতে দিন।
সেবাস্টিয়ান : আপনি কি বলতে চাচ্ছেন এই পত্রিকাটি মিথ্যা বলছে? আপনি কি বলতে চাচ্ছেন পত্রিকাগুলো মিথ্যা বলছে ?
দুঃখজনক হচ্ছে আমরা এখন জেনেছি যে আইনটিতে কিছু শব্দচয়ন দুর্বল এবং অস্পষ্ট রয়েছে যার অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। – গওহর রিজভী
রিজভী : আমাকে শুধু হ্যাঁ বা না উত্তর দিতে বলবেন না। আমাকে ব্যাখ্যা করতে দিন। এটা ঠিক যে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বলে একটা ব্যাপার রয়েছে । এটা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সহিংসতা, বিদ্রোহ এবং জনগণকে প্ররোচিত করা থেকে বিরত রাখতে করা হয়েছে। তবে আইনটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সরকার উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন, যেটি আইসিটি অ্যাক্ট ১৯৯৬ সালে পাশ হয়েছিল । আমাদের সরকার সেটাকে সংশোধন করেছে এবং বর্তমানে এটির নাম ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন। দুঃখজনক হচ্ছে আমরা এখন জেনেছি যে আইনটিতে কিছু শব্দচয়ন দুর্বল এবং অস্পষ্ট রয়েছে যার অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এ জন্য এটা বলা যাবে না যে, গণমাধ্যমকে বাকরুদ্ধ করা হয়েছে, বাংলাদেশে গনমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই, আমার আপনাকে জানানো উচিত যে শুধু ঢাকা থেকে প্রতিদিন ৬০টিরও বেশি দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়।
সেবাস্টিয়ান : আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে গত বছরের প্রথম নয় মাসে এই আইনের আওতায় আটশো’র বেশি মামলা করা হয়েছে যেখানে অনেক সুপরিচিত সম্পাদক ও উর্ধ্বতন সাংবাদিকদের টার্গেট করা হয়েছে । এমন এক আইনের আওতায় আটশো মামলা করা হয়েছে যা আপনার সরকার দৃশ্যত উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে। মনে হচ্ছে আপনার সরকারের এই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোন ধরনের জড়তা নেই, তাই না? আপনার আইনটি যে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার বিরুদ্ধে দমনের একটি অস্ত্র ছাড়া আর কিছু নয় – তা কি এখন স্বীকার করা উচিত না? এটাই তো সত্যি, তাই না ?
রিজভী : না, আমি আপনার সমালোচনা মেনে নিতাম এবং আপনার অভিযোগগুলো মেনে নিতাম যদি আপনি হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জিজ্ঞাসা করতেন যে এই ৮০০ মামলার কয়টি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে? আপনি ৮০০ বলে একটি সামগ্রিক সংখ্যা বলেছেন। আমরা যখন কোনো সন্ত্রাসবাদী হামলার মুখোমুখি হই আমাদের সেটার বিরুদ্ধে লড়তে হয়, কঠিনভাবে লড়তে হয়। সেই আটশোর মধ্যে কতজন সন্ত্রাসী? সেই ৮০০র মধ্যে কতজন অপরাধীর রয়েছে যারা সহিংস কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত? কোন রকম বিচার ছাড়াই আপনি আমাকে সংখ্যাটি বলেছেন। আমি আপনাকে সংখ্যাগুলোর দিকে আবারও তাকাতে চ্যালেঞ্জ করছি এবং তাদের মধ্যে আসলে সাংবাদিক কয়জন বলতে বলছি।
সেবাস্টিয়ান : তাহলে আমি সংখ্যাগুলো আরো ভাগ করে বলতে পারি। কেননা মানবাধিকার সংগঠনগুলো আপনার সরকারের বাকস্বাধীনতার ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, করোনা সংকট সমাধানে আপনার সরকারের উদ্যোগের সমালোচনা করায় সাংবাদিক, শিল্পী, শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ এবং এক্টিভিস্টদের আপনারা গ্রেপ্তার করেছেন । এমনকি গত জুনে আপনারা ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর মানহানি করে পোস্ট দেয়ার অভিযোগ ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছেন। তাকে শাস্তি হিসেবে জুভেনাইল ডিটেনশনে রাখা হয়েছে ।
রিজভী : ঠিক আছে, তাহলে এবার আমাকে আপনার প্রশ্নের আমার পক্ষে যতটা সম্ভব পরিষ্কার উত্তর দিতে দিন । আপনি আপনার দর্শকদের বলতে চাচ্ছেন যে করোনাকালে সরকার নানা ধরনের ভয়াবহ কাজ করেছে । আপনি কি আপনার দর্শকদের বলেছেন যে বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশের একটি যেটি আপনার নিজের দেশ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের চেয়ে ভালোভাবে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পেরেছে? যেখানে আমরা মহামারীকে খুব স্বল্প সামর্থ্য দিয়ে খুব ভালভাবে মোকাবিলা করেছি। আমাদের দেশে করোনায় মৃত্যুর হার বিশ্বের মধ্যে অন্যতম কম, আমাদের দেশে আরোগ্য লাভের হার সবচেয়ে বেশি। আমরা চিকিৎসা দিতে আমাদের হাসপাতালের পরিধি বাড়িয়েছি। এসব সত্যির উল্লেখ কোথাও নেই। আপনি ১৫টি উদাহরণ দিয়েছেন। আরো……
সেবাস্টিয়ান : আমি নিশ্চিত আপনি আলোচনার বিষয় বদলাতে চাচ্ছেন। আমি জানি যে আপনি আপনার সরকারের ভালো দিক বলতে চাচ্ছেন, কেননা আপনাকে এজন্য বেতন দেয়া হয় । আর এজন্যই আপনি সরকারের একজন উপদেষ্টা। কিন্তু আপনি কেন ইউএন কমিটি এগেইনস্ট টর্চারের উল্লেখিত বিস্তৃত এবং নিয়মিত নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা সংক্রান্ত প্রতিবেদনের দিকে নজর দিচ্ছেন না? আপনি নির্যাতনকে অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালে একটি আইন পাশ করেছেন। কিন্তু গত ছয় বছরে এই আইনের আওতায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে মাত্র ১৭টি এবং সেগুলো এখনো সম্পন্ন হয়নি। এটা কি একটি সরকারের জন্য গর্ব করার মতো অর্জন যেটি কিনা নির্যাতন বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে বলছে, তা নয়। তাই না? এটা একটা কলঙ্ক।
রিজভী : আসলে আমাকে আবারো বলতে দিন যে আপনি ঠিক এই অর্থে যে গত কয়েক বছরের নির্যাতন নিয়ে এই কয়টি মামলা হয়েছে কিন্তু কোনোটিরই বিচার এখনো শেষ হয়নি। আমি যদি আপনার বক্তব্য সত্য ধরে নিই তাহলে আমার এটা মেনে নিতে হবে যে এটা খুব ভালো কোনো রেকর্ড নয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে আমরা একটা আইন সত্যি পাস করতে পেরেছি। সত্যি কথা হচ্ছে আমরা বিষয়টি সুরাহার চেষ্টা করছি এবং আমি যেখানে বারবার আপত্তি জানাচ্ছি সেটা এটার জন্য নয় যে আপনি মনে করছেন আমাকে এমনটা করতে বেতন দেয়া হয়। আমি একই কথা আপনাকে বলতে পারি যে এটা কি সঠিক নয় যে আপনাকে বেতন দেয়া হচ্ছে আমাকে বারবার বিষয়টিকে বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে বিবেচনা না করে আক্রমণ করতে? এখন পর্যন্ত আপনি আমাকে যতগুলো প্রশ্ন করেছেন সবগুলোই নেতিবাচক মাত্রা নিয়েছে, এমনকি মহামারী বিষয়ক প্রশ্ন। আপনি খুব পরিস্কার ভাবে বলছেন যে, এসব ভয়ানক ব্যাপার ঘটেছে। আপনি আমাকে আর একটি দেশের নাম বলুন যারা আমাদের সরকারের মতো কার্যকরভাবে মহামারী মোকাবেলায় সক্ষম হয়েছে।
সেবাস্টিয়ান : ডক্টর রিজভী, আলোচনার বিষয় বদলানোর খুব ভালো কৌশল এটি । তবে আমি এই আলোচনা শুধু এজন্য ছাড়তে রাজি নয় যে আপনি বলেছেন আপনার সরকার মানবাধিকার লংঘনের রোধে উদ্যোগ নিচ্ছে। সরকার কি আপনার তথাকথিত র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে? কারণ জাতিসংঘ বলছে- এই বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে নির্যাতন, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, ঘোষণা না দিয়ে আটক রাখা, গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। আপনি আমাকে আপনার দেশ ভালো যা কিছু করেছে সে কথা বলেছেন, কিন্তু র্যাব আপনার সরকারের নামে যা করছে তা নিয়ে আপনি কি বিব্রত নন? আপনার সরকার তার নিজের নাগরিকদের হত্যা করছে।
রিজভী : আমাকে সততা, নম্রতা এবং বিব্রত বোধ থেকে বলতে হচ্ছে আপনি যেসব অভিযোগের কথা বলছেন তার কিছু সত্য। কিছু ঘটনা রয়েছে যা সরকারের মধ্যকার কেউই ডিফেন্ড করতে চাইবে না কিন্তু…….
সেবাস্টিয়ান : দায়িত্ব কার? দায়িত্ব কার? প্রশ্ন এটা নয় যে তারা তাদের ডিফেন্ড করবে নাকি করবে না। প্রশ্ন হচ্ছে দায়িত্বটা কার?
রিজভী : মিস্টার সেবাস্টিয়ান আপনি আমাকে একটি প্রশ্ন করেছেন, সেটার উত্তর দিতে দিন। আপনি আপনার প্রশ্ন যেটা বলেন নি তা হচ্ছে র্যাবের কতজন সদস্য কে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে? তাদের মধ্যে কতজনের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে এবং কতজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে? আপনি এগুলো উল্লেখ করেননি। এটা একটা সরকারের দায়িত্ব যে যখন এটি দেখতে পায় কোন কারনে মানবাধিকারের চরম লংঘন হচ্ছে বা আইনের ব্যত্যয় ঘটছে তখন সেই কারণে অনুসন্ধান করা। আমি মনে করি না তারা সব সময় সফল হয়, তবে বিরক্ত হই যখন তারা যে চেষ্টা করছে সেটার স্বীকৃতি দেয়া না হয়।
সেবাস্টিয়ান : ঠিক আছে। ডঃ গওহর রিজভী, আপনাকে কনফ্লিক্ট জোনে পেয়ে ভালো লাগলো। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
রিজভী : ধন্যবাদ মিস্টার সেবাস্টিয়ান। আপনার সঙ্গে কথা বলাটা আনন্দের ব্যাপার এবং একটা অভিজ্ঞতাও বটে।
আপনার মতামত জানানঃ