একদিকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হচ্ছে। অন্যদিকে আবার সেগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। উচ্ছেদ অভিযানের নামে দিনের পর দিন এভাবেই চলছে ভাঙা-গড়ার খেলা। এই চিত্র ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। শহরকে সুন্দর করতে অবৈধভাবে দখল করা রাস্তা, খাল, ফুটপাত দখলমুক্ত করতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে প্রশাসন। তবে উচ্ছেদের পর আবারও শুরু হয় দখল। কারণ একবার উচ্ছেদ করে উদাসীন হয়ে পড়ে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এ যেন বৃত্তাকার এক বিন্দুতে উচ্ছেদ-দখল খেলা।
জানুয়ারি মাসে ডিএনসিসি ৩৮টি উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। প্রতিটি উচ্ছেদ অভিযানে ডিএনসিসির ব্যয় অন্তত ২০ হাজার টাকা। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সম্মানী দিতে হয় তিন হাজার টাকা; পুলিশ, সার্ভে, পেশকার—তিন দলকে দিতে হয় তিন হাজার টাকা। আর আনুষঙ্গিক খরচ (শ্রমিক, খাবার, পরিবহন এবং অন্যান্য) ১৪ হাজার টাকা। এই হিসাবে জানুয়ারি মাসে চালানো ডিএনসিসির উচ্ছেদ অভিযানে ব্যয় হয়েছে সাত লাখ ৬০ হাজার টাকা। জানুয়ারিতে ডিএনসিসির উচ্ছেদ করা অবকাঠামোর সংখ্যা ৩০০৪টি। এর মধ্যে অস্থায়ী অবকাঠামো ২৭৫২টি, স্থায়ী অবকাঠামো ২৫২টি। এ ছাড়া ১৫ কিলোমিটার ফুটপাত উদ্ধার এবং ৪৫ হাজার বর্গফুট জায়গা দখলমুক্ত করে ডিএনসিসি। যদিও আবার দখল হতে শুরু করেছে এসব জায়গা।
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা গণমাধ্যমকে বলেন, বারবার আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা এসব এলাকায় গিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু দখলবাজরা আবারও সেখানে বসে পড়ে। এবার আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখছি। আশা করি এবার উচ্ছেদের পর আর জায়গাগুলো দখল হবে না। প্রয়োজনে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। গরিব মানুষ বলে এত দিন এটা করা হয়নি। এবার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাজধানীর পল্লবীতে জানুয়ারি মাসে টানা তিনদিনের উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। গত মাসের ২১, ২২ ও ২৩ তারিখের সেই অভিযানে প্রায় পাঁচ শতাধিক দোকানপাট ও অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করে ডিএনসিসি। তবে সময় গড়াতেই পুনরায় দখল হতে থাকে উচ্ছেদকৃত জায়গা। স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিনই বাড়ছে দখলের পরিমান। পূর্বে অভিজ্ঞতার তুলে ধরে তারা আরও জানিয়েছেন, প্রথমে বসানো হয় অস্থায়ী দোকান, পরে স্থায়ী নজরদারী না থাকায় তা চলে যায় স্থায়ী দখলে। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, সিটি করপোরেশনের কাউকে উচ্ছেদের পর আমরা আর দেখি নি।
এদিকে জুরাইন রেললাইনের দুই পাশে কিছুদিন আগে উচ্ছেদ করা হলেও তাতে অস্থায়ীভাবে দোকান বানিয়ে আবারও দখল করা হয়েছে। জুরাইন থেকে গেন্ডারিয়া স্টেশন পর্যন্ত একই অবস্থা। একই চিত্র রাজধানীর হাতিরপুল বাজারেরও। ফুটপাত থেকে দোকান উচ্ছেদ করা হলেও বর্তমানে ফুটপাতের বাইরের রাস্তাও দখল করে ব্যবসা করছে হকাররা। গুলিস্তানের রাস্তায় বারবার হকারদের উচ্ছেদ করা হলেও দখলমুক্ত হয়না অদৃশ্য কারণে।
অবৈধ দখলদারদের এবিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তারা বলেন, তারা নিজেদের উদ্যোগেই পুণরায় তুলছেন অস্থায়ী দোকান। দোকান ভেঙে দেয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন বলে জানান তারা। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মালপত্র বিক্রি করতেই তারা দোকান তুলছেন। নিজেরাই তুলতেছি।
উদ্ধার করা জায়গা কেন বারবার দখল হয় এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আকতার মাহমুদ বলেন, বিষয়টি আসলে দ্বিপক্ষীয়। এর জন্য আইনের প্রয়োগ যেমন প্রয়োজন, তেমনি সচেতনতাও প্রয়োজন। উদ্ধার করা জায়গা কিভাবে ব্যবহার করা হবে তার একটা টেকসই পরিকল্পনা থাকতে হবে এবং সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে। দখলদার উচ্ছেদ করে সেখানে কিছু না করে রেখে আসা যাবে না। এর জন্য ওয়ার্ড কমিশনারসহ স্থানীয়দের নিয়ে তদারকি টিম গঠন করতে হবে। তাহলে এসব জায়গা আর বেদখল হবে না।’
নগরবাসীরা বলছেন, ফুটপাত উচ্ছেদের পর নিয়মিত ফলোআপ না থাকায় এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। ফুটপাত ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের বিকল্প কোনো স্থানে না দিয়ে বার বার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা ও জরিমানা করা হয়। এ কারণে আর্থিক ও ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়েন তারা। জীবন চালাতে উচ্ছেদের পর আবারো ফুটপাতে ব্যবসায় নামেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উচ্ছেদের পর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির মনিটরিং না থাকার কারণে ফের দখল হয়ে যায় সেই জায়গা। রাজধানীতে উচ্ছেদের পর দখলের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, প্রথমে দখলমুক্ত জায়গা অস্থায়ীভাবে দখল করা হয়, পরবর্তীতে রূপ নেয় স্থায়ী দখলে। ফুটপাত দখলের অভিনব কায়দা হচ্ছে ভ্যান ও টুকরিতে মালামাল নিয়ে দোকানদারি করা। দোকানদারি শেষ করে ভ্যান বা টুকরি নিয়ে স্থান ত্যাগ করে হকাররা। পরদিন আবার দোকান করে। এক্ষেত্রে তাদের সুবিধা হল, প্রশাসন ফুটপাত দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদে আসলে ভ্যান বা টুকরি নিয়ে পালিয়ে যায় হকাররা। এতে মালামালের ক্ষয়ক্ষতি হয় না। প্রশাসনের লোকজন চলে গেলে আবারও ফুটপাতে ব্যবসা করতে চলে আসে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৮৫৫
আপনার মতামত জানানঃ