স্বামীর অবাধ্য হলে স্ত্রীকে স্বামী মারতে পারবে কিনা এবিষয়ে অনেক ধর্মপ্রাণের মনেই প্রশ্ন রয়েছে। তবে অধিকাংশ পুরুষই মনে করে স্ত্রী কথা না শুনলে তাকে মারার অধিকার স্বামীর রয়েছে। এবিষয়ে একমত পোষণ করে মাঠে ময়দানেও ওয়াজিরা বয়ান করে থাকেন। একইসাথে স্ত্রীজাতিকেও স্বামীর অবাধ্য না হওয়ার এক রকম হুঁশিয়ারিই দিয়ে রাখেন। স্ত্রী প্রহারে অধিকাংশ পুরুষ মত দিলেও কতোজন নারী এর সমর্থনে রয়েছে? ন্যাশনাল ইনস্টিটিটিউট অফ পপুলেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেইনিং-নিপোর্ট এর জরীপ জানায় যে, ৩৪ শতাংশ বিবাহিত কিশোরী এবং প্রায় ১৮ শতাংশ অবিবাহিত কিশোরী মনে করে স্ত্রী কথা না শুনলে স্বামী তাকে শারীরিকভাবে আঘাতের অধিকার রাখে।
বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণ পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে আনতে এই জরিপটি করা হয়। জরিপ করতে ন্যাশনাল ইনস্টিটিটিউট অফ পপুলেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেইনিং-নিপোর্টকে সহযোগিতা করেছে আইসিডিডিআরবির রিসার্চ ফর ডিসিশন মেকার্স, আরডিএম এবং ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনার ডাটা ফর ইম্প্যাক্ট, ডিফরআই। রাজধানীর একটি হোটেলে আজ বৃহস্পতিবার(১১ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশ করা হয় জরিপের ফল।
মূল প্রতিবেদনে কিশোর-কিশোরীর গণমাধ্যম ব্যবহার, বিয়ে, ঋতুকালীন স্বাস্থ্যবিধি, জেন্ডার-সম্পর্কিত সামাজিক আচরণ, সহিংসতা, মানসিক স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও খাদ্যবৈচিত্র্যের বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে।
জরিপে বলা হয়, জরিপে অংশ নেয়া এক-তৃতীয়াংশ (৩৪ শতাংশ) বিবাহিত কিশোরী এবং প্রায় এক-পঞ্চমাংশ (১৮ শতাংশ) অবিবাহিত কিশোরী মনে করে স্ত্রী কথা না শুনলে স্বামী তাকে শারীরিকভাবে আঘাতের অধিকার রাখে। বিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে তিন শতাংশ কিশোরীর বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে অথবা স্বামীর থেকে আলাদা আছে অথবা বিধবা হয়েছে।
অন্য একটি জরিপ থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশের বেশির ভাগ পুরুষই মনে করেন স্ত্রীকে মার দেওয়া যায়। গ্রামের ৮৯ শতাংশ পুরুষ মনে করেন স্ত্রী অন্যায় কিছু করলে স্বামীর মার দেওয়ার অধিকার আছে। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই শহরের পুরুষেরাও, তাদের ক্ষেত্রে এ হার ৮৩ শতাংশ।
রিপোর্টে এ ছাড়াও রয়েছে, শহরের ৯৩ শতাংশ এবং গ্রামের ৯৮ শতাংশ পুরুষই বিশ্বাস করেন পুরুষ হতে হলে তাকে কঠোর হতেই হবে। আবার শহরের ৫০ শতাংশ এবং গ্রামের ৬৫ শতাংশ পুরুষ বিশ্বাস করেন, পরিবারকে রক্ষা করার জন্য নারীদের নির্যাতন সহ্য করা উচিত।
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এর এক জরিপে দেখা গেছে, স্ত্রী নির্যাতনের পিছনে যে সকল কারণগুলো রয়েছে তার মধ্যে স্বামীর আদেশ অমান্য করা, সন্তানদের যত্ন না করা, স্বামীকে না বলে ঘরের বাইরে যাওয়া, ধর্মীয় আচার না মানা, স্বামীর পরকীয়ায় বাঁধা প্রদান, স্বামীর যৌন আগ্রহে সাড়া না দেয়া এবং স্বামীর সঙ্গে সাংসারিক ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়া।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্বামী কর্তৃক শারিরীক আঘাত আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন যে কোন নারীর মনেই যেমন কঠিন অপমানবোধ সৃষ্টি করে তেমনি আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন কোনো পুরুষই তার স্ত্রীকে শারীরিক আঘাত করতে পারেনা। সভ্য সমাজে এটা নিয়ে বোধ হয় তর্ক করার অবকাশ নেই। গবেষণার প্রাপ্ত তথ্য যে রীতিমত ভয়ংকর তা আরেকবার স্মরণ না করে উপায় নেই।এই গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে শহর এবং গ্রামে নারী নির্যাতনের যে চিত্র এবং ভয়াবহতা তা রীতিমত ভদ্র সমাজের নির্লজ্ব মুখোস টাই যেন উন্মোচিত হয়েছে।তাই এই চিত্রটি সমাজ এবং সমাজের যে কোনো বিবেকবান মানুষের জন্যই যথেষ্ট আতঙ্ক ও শঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে। গবেষণায় যে তথ্য বের হয়ে আসছে তাতে মনে হয় বউ পেটানো প্রথা আমাদের সমাজে গভীরভাবে মিশে আছেএবং ভদ্র পোশাকের আড়ালে এমন ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেই যাচ্ছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিটিউট অফ পপুলেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেইনিং-নিপোর্ট এর জরীপে আরও তথ্য পাওয়া গেছে যে, চলার পথে অবিবাহিত কিশোরীদের ৮৮ শতাংশই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। এদের ১৯ শতাংশ শিকার হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সময়।
জরিপে একটি আশাবাদী তথ্যও উঠে এসেছে। কিশোর-কিশোরীর মধ্যে ৯৭ শতাংশ জীবনের কোনো না কোনো সময় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় (স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসা) অংশগ্রহণ করেছে। দেশের ৯০ শতাংশ কিশোর-কিশোরী মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুবিধাপ্রাপ্ত। বিবাহিত কিশোরীদের প্রায় অর্ধেক ও অবিবাহিত কিশোরীর প্রায় এক-চতুর্থাংশের নিজস্ব মোবাইল ফোন আছে।
জরিপে দেখা যায়, ৭৩ শতাংশ অবিবাহিত কিশোরী এবং ৬৬ শতাংশ অবিবাহিত কিশোরী বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। তাদের মধ্যে প্রতি চারজনের একজন কিশোরী ঋতুকালীন সময়ে কমপক্ষে একদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ রাখে। তবে ঋতুকালীন স্বাস্থ্যকর আচরণের প্রবণতা এখনও বেশ কম। বিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে ৯ শতাংশ এবং অবিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে ১২ শতাংশ মাত্র।
জরিপ অনুযায়ী, ঋতুকালীন সময়ে কিশোরীদের মধ্যে এখনও স্বাস্থ্যকর প্যাড ব্যবহারের প্রবণতা কম। ৯৮ শতাংশ কিশোরী একাধিকবার ব্যবহৃত প্যাড সাবান-পানি নিয়ে পরিষ্কার করে ব্যবহার করে। অনেক সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার না করে পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করে৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৪৫
আপনার মতামত জানানঃ