শিল্প-কারখানায় জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন তেল, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের জন্য পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে এক-তৃতীয়াংশ অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এই সংখ্যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহাম, ইউনিভার্সিটি অব লিচেস্টার এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন মিলিতভাবে গবেষণাটি পরিচালনা করেন। ৯ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে পাঁচটির মধ্যে একটি মৃত্যুর জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারে সৃষ্ট বায়ুদূষণ দায়ী। গবেষণায় শক্তি উৎপাদন, শিল্প কারখানা ও পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে জ্বালানি ব্যবহারের হার তুলে ধরা হয়। নতুন এই গবেষণায় ২০১২ সালের বায়ুদূষণ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত ব্যবহৃত হয়েছে। সেবছর বায়ুদূষণে বাংলাদেশে ৬ লাখ ৯২ হাজার ৮১ জন মৃত্যুবরণ করে। তাদের মধ্যে ২ লাখ ৫২ হাজার ২৭ জনের মৃত্যু বায়ুতে উপস্থিত জীবাশ্ম জ্বালানির কণার কারণে হয়েছিল। অর্থাৎ প্রায় ৩৬ শতাংশ মৃত্যুর জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি দায়ী।
শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় চীনের নাম আছে প্রথমে। দেশটিতে জ্বালানি সৃষ্ট বায়ুদূষণে ৪০.২ শতাংশ মৃত্যু হয়ে থাকে। এই তালিকায় ৩০.৭ শতাংশ মৃত্যুহার নিয়ে ভারত আছে তৃতীয় অবস্থানে। দক্ষিণ কোরিয়া ও উত্তর কোরিয়ার আছে যথাক্রমে; চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে।
“গ্লোবাল বারডেন অফ ডিজিজ স্টাডিজের” সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে বায়ুদূষণে মৃত্যুর জন্য ইনডোর এবং আউটডোর বায়ুবাহিত কণা দায়ী। এর মধ্যে আছে ধূলাবালি, দাবানল বা কৃষি জ্বালানি থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া ইত্যাদি। ২০১৯ সালে এই মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০।
তবে হার্ভার্ডের গবেষণা বলছে ২০১২ সালে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে মোট মৃত্যুর মধ্যে ২ লাখ ৫২ হাজার ৯২৭ জনের মৃত্যুর জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি দায়ী। গবেষণাটিতে ১৪ বছরের নিচে শিশুদের মৃত্যুহার অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এছাড়া গবেষকরা ২০১৮-১৯ সালের তথ্য-উপাত্ত থাকা সত্ত্বেও ২০১২ সালের তথ্য ব্যবহার করেছেন।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়য়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য বেশ নির্ভরযোগ্য, কেননা তারা সবথেকে আধুনিক মডেল ও প্রযুক্তির ব্যবহার করেছে। তবে সংখ্যাগুলোর সামান্য রকমফের হতে পারে, কেননা মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দেশ অনুযায়ী ভিন্ন হয়।
“বাংলাদেশে জীবাশ্ম জ্বালানি ও অন্যান্য উৎসের কারণে বায়ুদূষণে মৃত্যুহার বেশ উচ্চ। সকল মৃত্যুর জন্যই মানুষের কার্যক্রম দায়ী। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস এবং অন্যান্য বায়ুদূষণের মাত্রা কমিয়ে আমরা এই অবাঞ্ছিত মৃত্যুগুলো ঠেকাতে পারি,” বলেন তিনি।
“উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার রাস্তায় দুই স্ট্রোক বিশিষ্ট তিন চাকার বেবিট্যাক্সি নিষিদ্ধ করে বায়ুদূষণ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো গিয়েছিল। একইভাবে আমরা যদি বিভিন্ন কারখানায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করতে পারি, আমরা মৃতের সংখ্যাও উল্লেখজনকভাবে কমাতে পারব,” ব্যখ্যা করেন কামরুজ্জামান।
তিনি আরও বলেন, কোভিড-১৯ চলাকালীন সময়ে প্রথম তিন মাসে বায়ুদূষণ পরিস্থিতি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুধরে গিয়েছিল। কেবলমাত্র প্রকৃতিতে মানুষের হস্তক্ষেপ কমার ফলেই তা সম্ভব হয়েছিল। একমাত্র নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমেই জীবশ্ম-জ্বালানি জনিত মৃত্যু কমানো সম্ভব। ১৯৯৫ সালে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ছিল ৫৪.৪ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৭৩.৮ শতাংশে গিয়ে পৌঁছে। এসময় গড় বার্ষিক জ্বালানি বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৬২ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, জলবায়ু সম্পর্কিত প্যারিস চুক্তির মূল লক্ষ্য হলো বৈশ্বিক তাপমাত্রার গড় বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা। কিন্তু এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ২০৩০ সাল নাগাদ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যে পর্যায়ে সীমিত রাখা দরকার, বর্তমানে বিশ্ব তার চেয়ে ১২০ শতাংশ বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের পথে রয়েছে। জাতিসংঘের জলবায়ু কর্মসূচির গবেষকরা এমনটাই জানিয়েছেন। অবশ্য আশার কথা হলো, কার্বন নিঃসরণ কমানো ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের গতি শ্লথ করার লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে বিনিয়োগকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব কমাতে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে জলবায়ুতে যে পরিবর্তন আসবে, তা ২০৩০ সাল নাগাদ ১০ কোটির বেশি মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ এমনিতেই বিশ্ব পরিবেশ দূষণের অন্যতম শিকার৷ বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির আরেকটি কারণ জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন ও ব্যবহার৷ জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থাৎ তেল, গ্যাস ও কয়লা ব্যবহারের ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে৷ ফলে বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে৷ বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের বিশাল এলাকা আজ সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যাওয়ার হুমকির সৃষ্টি হয়েছে৷ এ অবস্থায় অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহার, পরিবেশকে আরো দূষিত করতে পারে৷ কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য নয়, কিন্তু তারপরেও, এর বিপদের ভাগটা বাংলাদেশকেই নিতে হচ্ছে অনেক বেশি৷ বৈশ্বিক ঊষ্ণতার ফলে সমুদ্র উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা, এর ফলে বাংলাদেশের এক-পঞ্চমাংশ এলাকা সাগরে চলে যাওয়া, এইসব আশঙ্কার কথা, আমরা বেশ কয়েক বছর যাবৎ শুনে আসছি৷ কিন্তু এ পর্যন্ত কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি, অর্থাৎ পরিবেশ দূষণের শিকার দেশগুলো, আরও ধ্বংসের দিকে এগুচ্ছে৷
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/২১৩৩
আপনার মতামত জানানঃ