পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জায়গায় জায়গায় অনেক অনিয়ম ও সহিংসতার মতো ঘটনা ঘটেছে। এসবের অধিকাংশই হয়েছে প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচনী প্রচার কিংবা ক্ষমতা দখল নিয়ে। নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন করে প্রার্থীরা একেরপর এক ঘটনা চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন থেকে অবশ্য এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করা হয়ে আসছে বরাবর। এবার পুলিশের বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর হয়ে পুলিশের কাজ করার বিষয়টি এখন আলোচিত ঘটনা। আর এমনটি ঘটেছে মাদারীপুরের পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, পৌরসভা নির্বাচনের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মশিউর রহমান সবুজকে কালকিনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) গাড়িতে তুলে এসপির বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে এসপি নিজের গাড়িতে করে ঢাকায় আওয়ামী লীগ অফিসে নিয়ে আসেন। এমনকি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়েছিলেন শিবচর থানার ওসি মিরাজ হোসেন। বিশ্নেষকরা বলছেন, অভিযোগ দুটি নির্বাচনী আইন লঙ্ঘনের গুরুতর উদাহরণ।
জানা যায়, কালকিনি পৌরসভা নির্বাচনের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মশিউর রহমান সবুজকে গত শনিবার দুপুরে কালকিনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাসির উদ্দীন মৃধা সরকারি গাড়িতে তুলে মাদারীপুরের পুলিশ সুপারের কাছে নিয়ে আসেন। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ হন তিনি। নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ১১ ঘণ্টা পর ফিরে আসেন মাদারীপুরের কালকিনি পৗরসভা নির্বাচনের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মসিউর রহমান সবুজ। ফিরেই তিনি দাবি করেন, পুলিশ সুপারের (এসপি) গাড়িতে উঠিয়ে তাকে ঢাকায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরর সঙ্গে কথা হয়। তিনি আমাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করার আহবান জানান।’
মসিউর রহমান সবুজ দাবি করে বলেন, গতকাল (শনিবার) বিকেলে হঠাৎ এসপি আমাকে কল করে দেখা করতে বলেন। তিনি থানার ওসিকে আমার কাছে পাঠান। তখন আমি ওসির কাছে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলার বিষয় নিয়ে এসপি আমার সঙ্গে কথা বলবেন। পরে আমি সরল মনে তার গাড়িতে উঠে এসপি অফিসে যাই। সেখানে যাওয়ার পর এসপি আমাকে তার গাড়িতে উঠিয়ে ঢাকার ধানমন্ডি আওয়ামী লীগের পার্টি অফিসে নিয়ে যান। তখন রাত প্রায় ৮টা বাজে।
শনিবার পুলিশের গাড়িতে ওঠার পর সবুজ নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। এর জের ধরে তার সমর্থকেরা গতকাল সন্ধ্যা থেকে থানার সামনে অবস্থান নেন। পরে বিক্ষোভ, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালান বিক্ষুব্ধ সমর্থকেরা। একপর্যায়ে নৌকার সমর্থকদের সঙ্গে সবুজের সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়।
এ বিষয়ে কালকিনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাসির উদ্দীন মৃধা বলেন, নির্বাচন নিয়ে আলোচনার জন্য তিনি সবুজকে এসপির কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপরের কিছু তার জানা নেই।
শনিবার রাতে প্রার্থী নিখোঁজ হওয়ার গুঞ্জনের জের ধরে কালকিনিতে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। জনতা থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। এতে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। অথচ রোববার রাতে নির্বাচন কমিশন সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি এই মাত্র সাংবাদিকদের মাধ্যমে ঘটনা শুনেছেন। বিস্তারিত কিছু জানেন না। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছ থেকে কোনো তথ্য পেয়েছেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা জানালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) অথবা সচিবকে জানাবেন। তারা ভালো বলতে পারবেন।
সিইসিকে মোবাইল ফোনে না পাওয়া গেলে ইসি কার্যালয়ের সচিব হুমায়ুন কবির খোন্দকার গতকাল রোববার রাতে জাতীয় এক দৈনিককে জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি অবহিত নন। তা ছাড়া তিনি নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন। সব বিষয় এখনও বুঝে উঠতে পারেননি। জেনেবুঝে মন্তব্য করতে চান।
এদিকে মাদারীপুর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান ওই দৈনিককে জানিয়েছেন, তাদের কাছে কেউ অভিযোগ দেয়নি। তাই তারা কোনো কিছুই কমিশনকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। তবে সংবাদ মাধ্যমে খবর দেখে ইসি সচিবালয় থেকে তার কাছে দুপুরেই ঘটনা জানতে চাওয়া হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখানে নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘনের পাশাপাশি পেশাগত শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী এলাকার সংশ্নিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ইসির আদেশ মানতে বাধ্য। আর পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একজন প্রার্থীর প্রচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তাই নির্বাচন বন্ধ করে তদন্তের পর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এদিকে ২ ফেব্রুয়ারি শিবচরে ওসিকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে ওসি মিরাজ হোসেন দাবি করেছেন, নিরাপত্তা রক্ষার জন্য তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। প্রার্থীর সঙ্গে মিছিল কিংবা বাইরে একসঙ্গে ছিলেন না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, কোনো সরকারি কর্মকর্তা প্রার্থীর সঙ্গে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেন না। এটা আচরণবিধি লঙ্ঘন।
তারা জানান, কেবল মাদারীপুর পৌর নির্বাচনে নয়, দেশের অন্যান্য পৌর নির্বাচন, জাতীয় নির্বাচন কিংবা উপ-নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর হয়ে পুলিশের কাজ করার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। প্রার্থীর হয়ে নির্বাচনী প্রচারেও পুলিশকে দেখা গেছে। তারা মনে করেন, এতে নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘনের পাশাপাশি তারা দায়িত্বের বরখেলাপ করেছেন। পুলিশ যদি প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে নির্বাচনী কাজে অংশগ্রহণ করে তবে সে স্থানে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। পুলিশের এহেন কর্মকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ