মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান এবং এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করায় দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পোশাক আমদানিকারী অন্য দেশগুলো যে সুবিধা পাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র অগণতান্ত্রিক সরকারকে গ্রহণ করবে না। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, সামরিক অভ্যুত্থানের পর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বা অন্য কোনো দেশ বা জোট মিয়ানমারের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে। তাদের মতে, সুযোগ পেলে ক্রেতারা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য দেশগুলোতে ব্যবসা স্থানান্তর করবেন।
টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্প বিষয়ক জনপ্রিয় অনলাইন পত্রিকা ‘জাস্ট-স্টাইল’-এর প্রতিবেদন অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।
আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের (এএএফএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট নেট হারমান বলেন, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সোমবারের অভ্যুত্থান বেশ উদ্বেগজনক। আমরা দ্রুত গণতন্ত্রের অধিকার এবং প্রতিষ্ঠানসমূহকে পুনর্বহাল দেখতে চাই। যদি পরিস্থিতি একই রকম থাকে, তবে আমরা মার্কিন সরকারের কাছে দ্রুত নিষেধাজ্ঞা জারির আশা রাখব।’
ইন্ডাস্ট্রি গবেষক এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফ্যাশন প্রতিষ্ঠান ডিপ্লয় লন্ডনের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর বার্নিস প্যান বলেন, অভ্যুত্থানের কারণে বাংলাদেশে বাণিজ্য আংশিক স্থানান্তরিত হতে পারে। ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর বিকল্প উৎস থাকলেও প্রস্তুতকারীরা বড় এবং দীর্ঘ-মেয়াদী বিনিয়োগ করে থাকে। পোশাক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অভ্যুত্থানটি এক ‘জরুরি সতর্ক বার্তা’, তার ওপর দেশটির সামরিক শাসনের ইতিহাসও বেশিদিন আগের নয়। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই যাদের সরে আসার, তারা অন্য দেশগুলোতে সরে যাবে। দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য দেশ আছে যারা অপেক্ষাকৃত বেশি স্থিতিশীল, যেমন প্রতিবেশী বাংলাদেশ। মিয়ানমার অপেক্ষা তাদের সেবার মূল্যও কম বলেন প্যান।
তবে মিয়ানমার বাণিজ্য হারালে ভিয়েতনাম তেমন উপকৃত হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এর কারণ হিসেবে বলেন, ভিয়েতনাম সাধারণত উচ্চমানের, দামি পণ্য তৈরি করে থাকে। তারা আসলে মিয়ানমারের চেয়ে চীনের সঙ্গে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এদিকে অভ্যুত্থানের কারণে ক্রেতারা ঠিক সময়ে তাদের পণ্য হাতে পাবে কি না, তা নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা, বলেন প্যান। পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তার ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। ‘কখনো কখনো রাজনৈতিক এই অভ্যুত্থানগুলো কেন্দ্রমুখী হয়ে থাকে। বাকি সবাই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বলেন তিনি।
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে কয়েক বছর ধরেই ভালো করছে মিয়ানমার। মূলত ২০১৩ সালে ইইউর দেওয়া অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি সুবিধা দেওয়ার কারণে দেশটিতে পোশাকশিল্পের শক্ত ভিত তৈরি হয়। সেটি কাজে লাগিয়ে ১০ বছরের মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি ১ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে মিয়ানমার। যদিও দেশটির রাখাইন রাজ্যে গণহত্যার কারণে ইইউর জিএসপি সুবিধা পুনর্বিবেচনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
জিএসপির পাশাপাশি নানা সুবিধা দেওয়ার কারণে চীন ও থাইল্যান্ড থেকে পোশাকশিল্পে বিনিয়োগ আসে মিয়ানমারে। তবে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ চীনা। মিয়ানমারের পোশাক রপ্তানির ৫০ শতাংশের গন্তব্য ইইউ। জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রপ্তানি বাড়ছিল। মিয়ানমার টাইমস–এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৩৭ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে দেশটি। যদিও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তাদের রপ্তানি ছিল মাত্র ৮০ কোটি ডলার।
ইউরোপিয়ান কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ ইইউভুক্ত দেশগুলোতে মিয়ানমারের পোশাক রপ্তানি ছিল ১৫৪ কোটি ইউরোর। ২০১৯ সালে সেটি বেড়ে ২২১ কোটি ইউরোতে দাঁড়ায়। অন্যদিকে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালে মিয়ানমার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। পরের বছর সেটি প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ২৫ কোটি ৪২ লাখ ডলার হয়।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি ফজলুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পোশাক আমদানিকারী অন্য দেশগুলো যে সুবিধা পাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র অগণতান্ত্রিক সরকারকে গ্রহণ করবে না।
মিয়ানমার থেকে পোশাকের অর্ডার সরানো হলে বাংলাদেশ তার কিছু অংশ পাবে। তবে সবচেয়ে বেশি লাভ হবে ভিয়েতনামের। কেননা, চীনা বিনিয়োগকারীদের মিয়ানমারে কারখানার পাশাপাশি ভিয়েতনামেও কারখানা রয়েছে। তবে তিনি এও বলেন, মিয়ানমার থেকে এখানে অর্ডার আসলে কেমন লাভ হবে সেটা নিয়ে এখনই কিছু বলা ঠিক নয়। কেননা, সামরিক সরকার মাত্র কয়েকদিন আগে ক্ষমতায় এসেছে। তবে মিয়ানমার সস্তা পোশাক তৈরি করে বলে বাংলাদেশের সুযোগ বেশি বলেও মন্তব্য করেন ফজলুল হক। তিনি আরও বলেন, অনেক উন্নয়ন সহযোগী বাংলাদেশের ছোটখাট লুপহোলগুলো খুঁজে বের করে। কিন্তু মিয়ানমারের ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। এখানে ভারসাম্য নিয়ে সমস্যা আছে।
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপারেল ফেডারেশনের পরিচালক ফজলে শামীম এহসানও একই কথা বলেন। আমরা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে দেখছি না। তবে আমরা আশাবাদী, ক্রেতারা গণতন্ত্র ও মানবতার প্রতি সম্মান দেখিয়ে মিয়ানমার ছাড়বে বলেন তিনি।
এদিকে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বড় ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত ২০২০ সালে গত বছর সব মিলিয়ে রপ্তানি কমেছে ৫৭৩ কোটি ডলার বা প্রায় ৪৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকার। এর মধ্যে পোশাক রপ্তানি কমে গেছে ৫৬০ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলারের, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ৪৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। দেশের মোট রপ্তানির ৮৩ শতাংশই আসে পোশাক খাত থেকে। তবে অন্যান্য খাতের পণ্যের তুলনায় গড়ে পোশাক পণ্যের রপ্তানি কমেছে বেশি হারে।
সূত্র জানায়, গত বছর পোশাকের দরও কমে গেছে। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে নিটওয়্যার পণ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হওয়া ১২ ধরনের পোশাকের দর কমেছে আগের বছরের (২০১৯ সাল) তুলনায় ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর আট ধরনের ওভেন পোশাকের রপ্তানি মূল্য কমেছে গড়ে ১ শতাংশ।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মিয়ানমারে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশের সুযোগ আসতে পারে। সেটি হয়তো কালকেই আসবে না। মিয়ানমার থেকে ক্রয়াদেশ সরলে ভিয়েতনাম বেশি লাভবান হবে। কারণ, মিয়ানমারে বিনিয়োগকারী অনেক চীনারই ভিয়েতনামেও কারখানা আছে। তবে মিয়ানমার যেহেতু সস্তা পোশাক তৈরি করে, সেহেতু বাংলাদেশেও ক্রয়াদেশ আসতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১১১০
আপনার মতামত জানানঃ