গাধা শব্দটি আমাদের সমাজে একদিকে বাস্তব প্রাণীকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, আবার অন্যদিকে বোকা বা অযোগ্য কাউকে ব্যঙ্গ করার ভাষা হিসেবেও প্রচলিত। অথচ এই প্রাণীটি প্রকৃতপক্ষে যে চিত্র আমাদের চোখে ধরা হয় তার সঙ্গে বাস্তবতা মেলে না। মানুষের কল্পনা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক ভাষাচর্চায় গাধা এক ধরনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ফলে প্রশ্ন আসে—গাধা কি আসলেই গাধা, নাকি মানুষ নিজের সুবিধার্থে তাকে এমনভাবে তুলে ধরেছে?
গাধা মূলত ঘোড়ার কাছাকাছি প্রজাতির একটি প্রাণী। হাজার হাজার বছর আগে থেকেই মানুষ পরিবহনের কাজে, পণ্য বহনে এবং কৃষিকাজে গাধাকে ব্যবহার করেছে। মরুভূমি বা পাহাড়ি অঞ্চলে যেখানে ঘোড়া বা অন্য পশু টিকতে পারে না, সেখানে গাধা সহজেই চলাফেরা করতে পারে। শুষ্ক আবহাওয়া, কম পানি, কম খাবার—সব কিছু মানিয়ে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা আছে তার। এ কারণে বলা যায়, গাধা আসলে বুদ্ধিহীন প্রাণী নয়, বরং এক ধরনের টিকে থাকার বিশেষজ্ঞ।
আইকিউ বা বুদ্ধিমত্তার হিসাব সাধারণত মানুষের জন্য করা হয়। প্রাণীদের ক্ষেত্রে সরাসরি আইকিউ মাপা হয় না, তবে তাদের শেখার ক্ষমতা, সমস্যা সমাধান করার দক্ষতা আর স্মৃতিশক্তি দিয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গাধার শেখার ক্ষমতা যথেষ্ট উন্নত। একবার কোনো পথ চিনে গেলে বা কোনো পরিস্থিতি থেকে কষ্টে বাঁচতে পারলে সে দীর্ঘদিন তা মনে রাখতে পারে। কেউ কেউ একে গাফহার আইকিউ বলে মজা করেন, যেন গাধার বুদ্ধিমত্তা আলাদা কোনো স্কেলে মাপা যায়। বাস্তবে গাধা ঘোড়া কিংবা গরুর চেয়ে কম নয়, বরং অনেকে মনে করেন সে আরও সতর্ক। কারণ গাধা যখন বিপদ বুঝতে পারে, তখন অকারণে ঝুঁকি নেয় না। এ কারণে অনেক সময় মানুষ ভাবে, গাধা জেদি বা বোকা। আসলে এটি তার আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি।
আমাদের সংস্কৃতিতে যখন কাউকে বোঝানো হয় যে সে অযোগ্য বা কিছুই বোঝে না, তখন তাকে গাধা বলা হয়। এই ব্যবহার এসেছে মূলত প্রাণীটিকে অবমূল্যায়ন করার অভ্যাস থেকে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বিভিন্ন সাহিত্যে বা লোককথায় গাধাকে সবসময় নিচু চোখে দেখা হয়েছে। হয়তো কারণ, গাধা ছিল গরিব মানুষের বাহন। ঘোড়া ছিল রাজকীয়, যোদ্ধাদের বাহন, মর্যাদার প্রতীক। গাধা ছিল বোঝা টানার প্রাণী, শ্রমের প্রতীক। ফলে সমাজের দৃষ্টিতে গাধা মানে নিম্নস্তরের, মর্যাদাহীন। সেই ধারণা থেকেই ‘গাধা’ শব্দটি অপমানসূচক গালি হিসেবে গড়ে উঠেছে।
তবে বাস্তবতা হলো, মানুষ যদি কিছু না পাততে গাধা বলে, তবে সেটা আসলে মানুষের নিজেদের সীমাবদ্ধতার প্রতিফলন। যখন কেউ অযোগ্যতা বা অদক্ষতার প্রমাণ দেয়, তখন তাকে গাধা বলা হয় কেবল ব্যঙ্গ করার জন্য। অথচ গাধার প্রকৃত আচরণে অযোগ্যতার কোনো ছাপ নেই। বরং এ প্রাণী মানুষের ইতিহাসে এক অনন্য সহযাত্রী। মরুভূমির বাণিজ্য, পাহাড়ি পথে যাতায়াত, গ্রামীণ জীবন—সবখানেই গাধা মানুষের পরিশ্রম ভাগ করে নিয়েছে।
প্রাণীটির প্রতি মানুষের এই অবজ্ঞা এক ধরনের সাংস্কৃতিক পক্ষপাত। যেমন পশ্চিমা সাহিত্যেও গাধাকে বোকা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, আবার কখনো পরিশ্রমী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি ধর্মীয় কাহিনীতেও গাধার উপস্থিতি আছে। বাইবেলে যিশুখ্রিস্টকে গাধার পিঠে চড়ে জেরুজালেমে প্রবেশ করতে দেখা যায়, যা বিনয় ও সরলতার প্রতীক। আবার অনেক জায়গায় গাধা বোঝা বহনের কারণে নিছক হাসির উপাদান হয়ে উঠেছে।
মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায়, মানুষ যখন কাউকে ছোট করতে চায়, তখন এমন প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করে, যাকে তারা নিজের চেয়ে নিচু মনে করে। এভাবে গাধার নাম এসে যায়, কারণ সমাজে তার কোনো রাজকীয়তা বা সম্মান নেই। কিন্তু যদি গাধাকে কাছ থেকে দেখা যায়, তবে বোঝা যাবে সে কতটা শক্তিশালী, সহিষ্ণু এবং অভিযোজনক্ষম। গরমে, পানিশূন্যতায়, দীর্ঘ পথচলায় যেভাবে গাধা টিকে থাকে, তা অনেক প্রাণীর পক্ষে সম্ভব নয়।
এই বৈপরীত্যই আসলে গাধাকে নিয়ে আমাদের ভুল ধারণার জন্ম দিয়েছে। আমরা যে প্রাণীটিকে অযোগ্যতার প্রতীক ভেবে গালি দিই, সেই প্রাণীই টিকে থাকার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তার শেখার ক্ষমতা আছে, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রবণতা আছে, এমনকি মানুষের সঙ্গে মিশে কাজ করারও সক্ষমতা আছে। গাধা কখনোই আসল অর্থে গাধা নয়। বরং মানুষই তার সীমাবদ্ধতা ঢাকতে তাকে এমন নামে ডেকেছে।
আজকের দিনে প্রয়োজন গাধা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো। শিক্ষার্থীদের বা কর্মজীবীদের বোকা বোঝাতে ‘গাধা’ শব্দ ব্যবহার করা সহজ, কিন্তু তা প্রাণীটির প্রতি অবিচার। একইসঙ্গে এটি মানুষের পক্ষপাতী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। সমাজ যদি সত্যিই বুদ্ধি, পরিশ্রম এবং অভিযোজনকে সম্মান করতে শেখে, তবে গাধা কোনো গালির প্রতীক থাকবে না। বরং সে হবে ধৈর্য আর সহিষ্ণুতার প্রতীক।
মোট কথা, গাধাকে বোঝা বা বোকা বলা মানুষের সামাজিক অভ্যাস, বাস্তব নয়। প্রাণীটি তার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার যে ক্ষমতা দেখিয়েছে, তাতে বলা যায়—গাধা আসলেই গাধা নয়, বরং পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান আর টিকে থাকার এক বিস্ময়কর প্রতীক। তাই যখন আমরা কাউকে অবহেলায় গাধা বলি, তখন আসলে আমরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতাই প্রকাশ করি।
আপনার মতামত জানানঃ