দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন এক সমীকরণের সূচনা হচ্ছে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং চীনের মধ্যে বাড়তে থাকা ঘনিষ্ঠতা ইতিমধ্যেই ভারতের জন্য একটি কৌশলগত উদ্বেগে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলটি ভারতকেন্দ্রিক প্রভাববলয়ের মধ্যে থেকেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথে ভারতের প্রভাব ছিল প্রবল। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন এবং তার বৈদেশিক নীতি দক্ষিণ এশিয়ার এই পুরনো সমীকরণ ভেঙে নতুন বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের নতুন সরকার পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করার যে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছে, তা ভারতের কৌশলগত অবস্থানকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি নতুন বাস্তবতাকে আরও জটিল করেছে। দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হলেও সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে নানা কারণে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লির মধ্যে নীতিগত মতপার্থক্য বাণিজ্য থেকে শুরু করে কৌশলগত সহযোগিতা পর্যন্ত বিস্তৃত। এর ফলে ভারত এমনিতেই এক ধরনের কূটনৈতিক চাপে ছিল। এই প্রেক্ষাপটে পূর্ব সীমান্তে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা, তার সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও সামরিক সহযোগিতা ভারতের নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক পরিসরকে সংকুচিত করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের শীতলতা বজায় ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত স্মৃতি, পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা ও নারীদের ওপর নির্মম নির্যাতনের ইতিহাস দুই দেশের সম্পর্কের সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে। শেখ হাসিনা সরকারের সময় এই সম্পর্ক আরও শীতল ছিল। তিনি পাকিস্তানের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনা দাবি করতেন এবং পাকিস্তান তা কখনোই দেয়নি। কিন্তু শেখ হাসিনার পতনের পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানের ফলে তাকে দেশ ছাড়তে হয়। তার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে পাকিস্তানবিরোধী অবস্থানও দুর্বল হয়ে যায়।
এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সাম্প্রতিক ঢাকা সফর দুই দেশের সম্পর্কে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। ১৩ বছরের মধ্যে এটি ছিল প্রথম কোনো উচ্চপর্যায়ের পাকিস্তানি সফর। সফরে তিনি বাংলাদেশকে ৬০০টি উচ্চশিক্ষাবৃত্তি, যুদ্ধাহত ব্যক্তিদের জন্য ৪০ জনের কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব দেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর—যার মধ্যে কূটনীতিকদের ভিসামুক্ত ভ্রমণ, বাণিজ্য বাড়াতে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন, কৃষি ও টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগের অঙ্গীকার অন্যতম। এছাড়া পাকিস্তান বাংলাদেশে সরাসরি বিমান চালুর ঘোষণা দেয়, যা ২০১৮ সাল থেকে বন্ধ ছিল। সম্প্রতি পাকিস্তানি জাহাজ চট্টগ্রামে নোঙর করেছে, যা ১৯৭১ সালের পর দুই দেশের মধ্যে প্রথম সরাসরি সমুদ্র যোগাযোগ। এগুলো নিছক কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; বরং দুই দেশের মধ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ে তোলার কৌশলগত প্রয়াসের অংশ।
বাংলাদেশের নতুন সরকারের আরেকটি বড় কূটনৈতিক পদক্ষেপ হলো চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা। ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর ছিল বেইজিংয়ে। সেখানে বাংলাদেশ ২.১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ, অনুদান এবং বিনিয়োগ চুক্তি পেয়েছে। চীন মংলা বন্দর আধুনিকায়নে ৪০০ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে। বন্দর, অবকাঠামো, জ্বালানি খাত—সবখানেই চীনের অর্থনৈতিক উপস্থিতি বাড়ছে। তাছাড়া সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। বাংলাদেশ চীন থেকে ১২টি জে-১০সি যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা করছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এসব সহযোগিতা শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং সামরিক ও কৌশলগত মাত্রায় ভারতকে অস্বস্তিতে ফেলছে।
ভারতের উদ্বেগ এখানেই শেষ নয়। শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে আশ্রয় নেওয়ায় দুই দেশের সম্পর্ক নতুনভাবে তিক্ত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের নতুন প্রশাসন অভিযোগ করছে, ভারত থেকে আওয়ামী লীগের বাংলাদেশবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এর ফলে দুই দেশের পারস্পরিক সন্দেহ আরও গভীর হয়েছে। এদিকে ভারতও উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রিপোর্টে উঠে এসেছে, গত এক বছরে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর চাপ বেড়েছে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, এসব ঘটনা শুধুমাত্র মানবিক ইস্যুই নয়, বরং ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ইতিমধ্যেই ভিসা ও বাণিজ্যে পারস্পরিক বিধিনিষেধ জারি হয়েছে। একদিকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে চীনের বিনিয়োগে সামরিক ক্রয় পরিকল্পনা ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি করছে। ভারত আশঙ্কা করছে, এই ত্রিপক্ষীয় ঘনিষ্ঠতা ভবিষ্যতে পূর্ব সীমান্তে এক নতুন কৌশলগত ঘেরাও তৈরি করতে পারে। এমনকি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নতুন এক ব্লকের জন্ম দিতে পারে, যেখানে ভারত তার প্রভাব খুইয়ে ফেলবে।
তবে সবকিছুর মধ্যেই আশা রয়েছে। ভারতীয় কূটনীতিকরা মনে করছেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে সম্পর্ক পুনর্গঠনের সুযোগ তৈরি হতে পারে। কিন্তু সেই পর্যন্ত সময় ভারতকে অনেক কৌশলগত ধৈর্য ধারণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, ভারতকে মানবিক কারণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য ভিসা সুবিধা সহজ করতে হবে, যাতে দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক ক্ষুণ্ন না হয়। একইসঙ্গে বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে যে, ভারতের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন করার মতো কোনো কার্যক্রম তারা সহ্য করবে না।
এখানে একটি বড় প্রশ্ন থেকে যায়—বাংলাদেশ কি আসলেই পাকিস্তান ও চীনের ঘনিষ্ঠতা ভারতের ক্ষতির জন্য ব্যবহার করবে, নাকি এটি কেবলই একটি ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক পদক্ষেপ? বাংলাদেশের নতুন সরকার ঘোষণা দিয়েছে, ঐতিহাসিক বিষয়গুলো যেমন ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ, আটকে থাকা সম্পদ বা পাকিস্তানি নাগরিকদের প্রত্যাবর্তন—এসব তাদের সম্পর্কের পথে আর বাধা হয়ে থাকবে না। তারা বরং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার পক্ষে। যদি সত্যিই এটি তাদের নীতি হয়ে থাকে, তবে বাংলাদেশ চাইছে একটি বহুপাক্ষিক সহযোগিতা জোরদার করতে, যেখানে ভারতকেও অংশীদার হিসেবে পাওয়া সম্ভব।
কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক মহলে ভিন্ন সুর শোনা যাচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসন আসলে ভারতবিরোধী অবস্থান নিচ্ছে। তাদের শঙ্কা, পাকিস্তানকে বাংলাদেশে গোপনে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে, যা ভারতের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করবে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের উচিত হবে প্রতিবেশী নীতিতে নতুন চিন্তা আনা। কঠোর কূটনৈতিক ভাষা ও সামরিক প্রস্তুতির পাশাপাশি মানবিক কূটনীতি বাড়াতে হবে, যাতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে পারে।
পুরো পরিস্থিতি একদিকে ভারতের জন্য কৌশলগত চাপের, অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির জন্য এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। যদি পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও চীন একসঙ্গে কোনো কৌশলগত জোট গড়ে তোলে, তবে এটি কেবল ভারতের জন্যই নয়, বরং গোটা অঞ্চলের শক্তির ভারসাম্য পাল্টে দিতে পারে। ভারত তখন বাধ্য হবে তার পূর্ব সীমান্তে বাড়তি সামরিক ব্যয় করতে, যা অর্থনীতিতেও চাপ সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ এই ঘনিষ্ঠতা ব্যবহার করে অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পেতে পারে। পাকিস্তানও এই সুযোগে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নতুন করে প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে নিতে পারবে।
তবে শেষ পর্যন্ত নির্ভর করছে কূটনীতির ওপর। বাংলাদেশ যদি সত্যিই বহুপাক্ষিক সহযোগিতা জোরদার করতে চায়, তবে তার জন্য দরকার হবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল রাখা। পাকিস্তান ও চীনের ঘনিষ্ঠতা দিয়ে বাংলাদেশ স্বল্পমেয়াদে সুবিধা পেলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি তাকে কৌশলগত চাপের মুখে ফেলতে পারে। অন্যদিকে ভারত যদি প্রতিবেশী নীতিতে কঠোরতা না দেখিয়ে নমনীয়তা প্রদর্শন করে, তবে পুরো অঞ্চলই লাভবান হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন অনেক সুযোগ এসেছে, যেখানে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করার পরিবর্তে দেশগুলো পারস্পরিক বিরোধে শক্তি নষ্ট করেছে। এবার যদি বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চীন ও ভারত ভিন্ন পথ বেছে নেয়, তবে দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল হতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ