গত বছরের জুলাইয়ে যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা নিছক একটি কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল না—বরং একটি দীর্ঘকাল ধরে জমে থাকা সামাজিক অসন্তোষের বিস্ফোরণ। “আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই”—এই আবেগপ্রবণ স্লোগানই আন্দোলনের চরিত্র এবং আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করেছিল। কিন্তু এক বছর পর ফিরে তাকালে, সেই আন্দোলনের জোয়ারে যা কিছু পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল, বাস্তবে তা হয়নি বললেই চলে। শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনের পতনের পর যে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এল, তাদের কাছ থেকে ছিল উচ্চ প্রত্যাশা। তবে বাস্তবতা হলো, সেই সরকারের প্রতিটি স্তরে আগের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কালচারেরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এ যেন পুরনো কাঠামোর মধ্যে নতুন মুখ বসানো—কিন্তু চিন্তাধারা, অভ্যাস, ক্ষমতার ব্যবহার একেবারেই অপরিবর্তিত।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নিয়োগে অনেকেই আশান্বিত হয়েছিলেন। এমন একজন শান্তিতে নোবেল বিজয়ীর নেতৃত্বে প্রশাসনের সংস্কার হবে, দুর্নীতি কমবে, রাষ্ট্রীয় সেবা সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য হবে—এমন ধারণাই ছিল অনেকের। কিন্তু যাত্রা শুরুর ক’দিন পরই দেখা গেল ভিন্ন বাস্তবতা। প্রটোকলহীনভাবে যানজটে আটকে থাকা ইউনূসের একটি মুহূর্ত ভাইরাল হলে জনমনে আশার সঞ্চার হয়, কিন্তু তারপরের ঘটনাগুলো আশাভঙ্গই ডেকে আনে। আবার সেই পুরনো ভিআইপি কালচার, স্যার কালচার, ফাইল ঠেলাঠেলি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির বিস্তারই চলে আসতে থাকে—এমনকি অনেকক্ষেত্রে তা আরও সূক্ষ্ম, লুকোনো ও দুর্বোধ্য রূপ নেয়।
রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা একমত যে, বৈষম্য দূর করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে যারা নেতৃত্বে এসেছিলেন, তাদের বড় অংশই আগের আমলের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। এতে পরিষ্কার বোঝা যায়, শুধু নেতৃত্ব পরিবর্তন করলেই কাঠামোগত বৈষম্য দূর হয় না—প্রয়োজন চিন্তাগত রূপান্তর এবং সক্রিয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। যেমন কুমিল্লার মুরাদনগরে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বাবার বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ, কিংবা শত কোটি টাকার দুর্নীতির মামলায় উপদেষ্টাদের জড়িত থাকার ঘটনাই প্রমাণ করে, ক্ষমতা হাতে পেলেই মানুষের চরিত্র বদলায় না। বরং পুরনো শিক্ষায় গড়া নতুন নেতৃত্ব পুরনো শাসকদের মতোই আচরণ করতে শেখে।
এছাড়া এনসিপির মতো রাজনৈতিক সংগঠনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। নতুন নেতৃত্বের অনেকে নিজেদের এলাকায় যান শত শত গাড়ির বহর নিয়ে, সমাজে ‘নেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে গিয়েই তারা ঠিক আগের শাসকদের মতো আচরণ করতে শুরু করেন। এমনকি সরকারি বই ছাপায় কমিশন বাণিজ্য থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসক নিয়োগে হস্তক্ষেপ—সব কিছুতেই ক্ষমতার অপব্যবহার চলতে দেখা গেছে। বিষয়টি এখানেই থামে না। ছাত্র আন্দোলনের অনেক নেতা যারা কোটা বাতিলের নামে বৈষম্যবিরোধী লড়াইয়ে ছিলেন, তারাই আজ কোটা, সুপারিশ, তদবিরের রাজনীতিতে মগ্ন।
আরও যে দিকটি গভীরভাবে ভাবনার দাবি রাখে, তা হলো নারী অংশগ্রহণ এবং তার প্রতিদান। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাইয়ের রাত, যখন রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বাইরে বেরিয়ে এলেন—সেই দৃশ্যটি পুরো আন্দোলনের চেহারা বদলে দিয়েছিল। নারীদের সে সাহসিকতা বাংলাদেশে বিরল। অথচ আন্দোলনের এক বছর পর তারাই সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। আবাসিক হলের বৈষম্যমূলক নিয়ম, পোশাক বা চলাফেরায় হেনস্তা, পেশাগত জীবনে বাধা, এমনকি যেসব পুরুষ হেনস্তাকারী নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছিল, তাদেরকেও পুনর্বাসনের অভিযোগ উঠেছে। এ যেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় পরিহাস।
এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন আসে, তাহলে কেন এই পরিবর্তন এলো না? বিশ্লেষকরা মনে করেন, নতুন সরকার জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে আসলেও বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। একদিকে আমলাতন্ত্রের অপরিবর্তিত রূপ, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্কহীনতা প্রশাসনকে একটি শূন্যতার মধ্যে ফেলে দেয়। যে সময়টিতে প্রয়োজন ছিল শক্ত অবস্থান, সাহসী সিদ্ধান্ত, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা—তখনই সরকার গা ভাসানোর নীতি নেয়। এই প্রশাসনিক দুর্বলতা শুধু সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নেই নয়, বরং পুরো ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
আরো গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়, এই আন্দোলনের ভেতরে জন্ম নেয়া দলগুলো নিজেরাই এক ধরনের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। এনসিপি যেমন প্রথমদিকে পরিবর্তনের বার্তা দিলেও, ধীরে ধীরে তা হয়ে ওঠে আরেকটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। আবদুর রাজ্জাক রিয়াদের চাঁদাবাজির অভিযোগ, বা হাসিবুর ইসলাম নাসিফের ভেতরের ‘কোটাবাজি’ এবং বিভাগীয় সফরের মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ড—সব কিছুই আন্দোলনের মূল চেতনাকে ধুলিস্যাৎ করে দেয়। ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে একটি গভীর হতাশা জন্ম নিয়েছে—আন্দোলনের নাম করে যে নেতৃত্ব উঠে এসেছে, তারা পুরনো কাঠামোরই আরেক রূপ।
আর একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো তথ্যের স্বচ্ছতা এবং সমাজের অংশগ্রহণ। আন্দোলনের সময় নাগরিকরা যে সরব ছিলেন, এখন তারা অনেকটাই নীরব। কারণ তারা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। আন্দোলনের যাদের মুখপাত্র হিসেবে তারা দেখেছেন, আজ তারাই রাষ্ট্রীয় সফরে অংশ নিচ্ছেন, ভাই-বন্ধু কোটা চালু করছেন, ক্ষমতার কাছে নতি স্বীকার করছেন। এই বিশ্বাসহীনতা গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। কারণ তা ভবিষ্যতের কোনো আন্দোলন বা পরিবর্তনের সম্ভাবনাকেও ধ্বংস করে দেয়।
সবশেষে বলা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এক সময় গণজাগরণ সৃষ্টি করলেও, এক বছরে তার অর্জনের চেয়ে ক্ষয়ক্ষতি বেশি। পুরনো কাঠামো, পুরনো শাসনচর্চা, দুর্নীতি, দলীয়করণ, লোভ—সব কিছুই নতুন মোড়কে ফিরে এসেছে। আন্দোলন বাঁচার ছিল, তা হয়ে গেছে বেচার হাতিয়ার। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহা মির্জার ভাষায়, “সরকার যতটা ব্যর্থ হয়েছে, তার চেয়েও বড় ব্যর্থতা হলো, যারা সরকারের বিকল্প হিসেবে সামনে এসেছিল, তারাও তাদের প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি।” এই ব্যর্থতার খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ—যারা বদলের জন্য জীবন বাজি রেখে রাস্তায় নেমেছিল, আজ তারাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত।
আপনার মতামত জানানঃ