মাইক্রোচিপ নিয়েই এখন কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা হচ্ছে। বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, বৈশ্বিকভাবে ইলেকট্রনিকস ডিভাইসের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে সংশ্লিষ্ট ডিভাইসগুলোয় চিপের চাহিদাও। এতে প্রসারিত হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর ব্যবসা বা চিপ নির্মাণ খাত। চিপ তৈরিতে এত দিন শুধু মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো একচ্ছত্র আধিপত্য দেখিয়েছে। কিন্তু এখন চিপের রাজ্যে হানা দিয়েছে তাইওয়ান। চীন নিজেদের একটি প্রদেশ হিসেবে বিবেচনা করা এ তাইওয়ান এখন কম্পিউটার চিপের জগতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর এ খাতের বেশির ভাগ ব্যবসা রয়েছে তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির (টিএসএমসি) অধীনে।
বিশ্বে মাত্র তিনটি কোম্পানি রয়েছে যারা সুপার অ্যাডভান্সড চিপ উৎপাদন করতে পারে। এই তিন কোম্পানি হলো- তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি), ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক ইনটেল এবং দক্ষিণ কোরিয়ার টেক জায়ান্ট স্যামসাং। প্রতিদ্বন্দ্বী ইনটেল হোঁচট খাওয়ার পর বিশ্ব এখন সর্বাধিক উন্নত সেমিকন্ডাক্টরের জন্য তাইওয়ানের কোম্পানি তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির (টিএসএমসি) ওপর ক্রমান্বয়ে বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। টিএসএমসির বর্তমান সাফল্য এবং চিপের শীর্ষস্থানীয় বৈশ্বিক সরবরাহকারী হিসেবে এর অবস্থান— একটি জটিল সময়ে গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি হিসেবে এটিকে হাজির করেছে।
ইন্টেল করপোরেশন গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে বৈশ্বিক চিপ ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তার করে শীর্ষে রয়েছে। মার্কিন সেমিকন্ডাক্টর এই কোম্পানি তাইওয়ান ভিত্তিক সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি) এর কাছে এখন আধিপত্য হারাতে বসেছে। টিএসএমসির কারণে ইন্টেলের এ ব্যবসা এখন হুমকির সম্মুখীন। কারণ টিএসএমসির বর্তমান বড় গ্রাহকদের তালিকায় রয়েছে অ্যাপল, কোয়ালকম ও এএমডির মতো প্রতিষ্ঠান।
সম্প্রতি অটো শিল্পের চিপ সংকটের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা তাইওয়ানকে পার্কিং সেন্সর থেকে কার্বন নির্গমন হ্রাস পর্যন্ত সবকিছুর জন্য সংস্থাগুলো চিপের ওপর নির্ভরশীল। আর এ চিপ সংকটের কারণে জার্মানির ভক্সওয়াগন এজি, যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ড মোটর কোং ও জাপানের টয়োটা মোটর করপোরেশনসহ গাড়ি শিল্পের সংস্থাগুলো উৎপাদন কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে। এর পরই বিশ্ব অর্থনীতিতে তাইওয়ানের ভূমিকা নতুন করে সামনে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানি গাড়ি প্রস্তুতকারকরা সংকট মোকাবেলায় তাইওয়ান ও টিএসএমসিকে পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানাতে তাদের সরকারগুলোর সঙ্গে তদবির করছে। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ গত বছর সংকটজনিত সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং ইউরোপে নিজস্ব চিপ উৎপাদন ত্বরান্বিত করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে একমত হয়েছেন।
অটো শিল্পের আবেদনের এ চিত্রটি তুলে ধরেছে টিএসএমসির চিপমেকিং দক্ষতা কীভাবে তাইওয়ানকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী করে তুলেছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রযুক্তি সংস্থাগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। এ পরিস্থিতি জো বাইডেন প্রশাসনের অধীনেও অব্যাহত থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। সেমিকন্ডাক্টর ব্যবসায়ে তাইওয়ানের নেতৃত্বে বেইজিংয়ের ক্রমাগত আগ্রাসনের হুমকি মোকাবেলায় টোকিও থেকে ওয়াশিংটনের স্বনির্ভরতা বাড়ানোর পরিকল্পনাগুলোকে ত্বরান্বিত করেছে।
এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসন চীনা প্রযুক্তি জায়ান্টগুলোকে নিষিদ্ধ করে প্রযুক্তি খাতে স্বনির্ভরতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র অ্যারিজোনায় ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের চিপ ফ্যাব্রিকেশন প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য টিএসএমসির সঙ্গে আলোচনা করছে। এছাড়া টেক্সাসে ১ হাজার কোটি ডলার ব্যয়ে একটি চিপ প্ল্যান্ট তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং ইলেকট্রনিকস কোং।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বৈশ্বিক চিপ মার্কেটে ইউরোপের অংশীদারিত্বকে ২০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতা অর্জন করতে চাইছে। এখন ২৭ দেশের এ জোট বৈশ্বিক চিপ বাজারের ১০ শতাংশেরও কম অংশীদার। এ জোটটি সদস্য দেশগুলোতে তাইওয়ানের বিনিয়োগ বাড়াতেও উৎসাহিত করছে।
সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহে তাইওয়ানই একমাত্র খেলোয়াড় নয়। এ খাতে বিশেষ করে চিপ ডিজাইন ও বৈদ্যুতিক সফটওয়্যার সরঞ্জামে যুক্তরাষ্ট্রও প্রভাবশালী অবস্থানে রয়েছে। তবে আরো ছোট চিপ তৈরিতে অনন্য উচ্চতায় উঠে গেছে টিএসএমসি। এটি তাইওয়ানকে একটি বিস্তৃত বাস্তুতন্ত্র তৈরিতে সহায়তা করেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় চুক্তিভিত্তিক চিপ নির্মাতা টিএসএমসি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৭ সালে। আর্থিক সঙ্কটের কারণে যেসব কোম্পানির পে তাদের নিজস্ব কারখানায় চিপ উৎপাদন সম্ভব ছিল না, তাদের সহায়তা দিতেই টিএসএমসি প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় অনেকেই টিএসএমসির এমন পদক্ষেপের সমালোচনা করেছিলেন। এ দলে ছিলেন মার্কিন সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি অ্যাডভান্সড মাইক্রো ডিভাইসের (এএমডি) প্রতিষ্ঠাতা জেরি স্যান্ডার্সও। আশার খবর হলো সময়ের পরিক্রমায় উন্নত প্রসেসর তৈরিতে এএমডি সম্প্রতি টিএসএমসিকে বেছে নিয়েছে। এএমডি সম্প্রতি তাদের বিনিয়োগকারী ও গ্রাহকদের জানায়, নতুন চিপ ইন্টেলের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হবে।
চিপ তৈরিতে চমক দেখানোর ফলে বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান নতুন ডিজাইনের চিপ তৈরিতে টিএসএমসির সহায়তা নিচ্ছে। টিএসএমসির বড় গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে অ্যাপল, কোয়ালকম ও এএমডি। এসব কোম্পানির চাহিদা অনুযায়ী, চিপ তৈরির মাধ্যমে প্রযুক্তিগত দাতা বাড়াচ্ছে টিএসএমসি। ফলে প্রতিষ্ঠানটির পে উন্নত প্রযুক্তির চিপ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। অ্যাপলের চুক্তিভিত্তিক পণ্য সরবরাহকারীদের মধ্যে অন্যতম টিএসএমসি। আইফোন ৮, ৮ প্লাস এবং আইফোন টেনের জন্য এ১১ প্রসেসর তৈরির কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া আইফোন ৬এস ও আইফোন ৬এস প্লাসে ব্যবহৃত এ৯ চিপসেট টিএসএমসি ও স্যামসাং যৌথভাবে উৎপাদন করেছিল। আইফোনে ব্যবহৃত চিপের ক্ষেত্রে স্যামসাং নির্ভরতা কমিয়ে টিএসএমসিতে ভরসা রাখছে অ্যাপল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪২
আপনার মতামত জানানঃ