সড়কে নিয়মিতই ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রতিদিন সড়কে গড়ে প্রাণ ঝরছে ২০ জনের। দুর্ঘটনা রোধে বছর জুড়ে ছিল না দৃশ্যমান উদ্যোগ। জুলাইয়ের পর সড়কে বিশৃঙ্খলা বেড়ে চরম পর্যায়ে ঠেকেছে। অবৈধ অটোরিকশায় সয়লাব হয়েছে রাজধানীর সড়ক-মহাসড়ক। সড়কজুড়ে ভেঙে পড়েছে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। বছরের শেষদিকে তা কিছুটা উন্নতির দিকে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দুর্বৃত্তরা ভাঙচুর করেছে মেট্রোরেলে। ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে সড়ক ও বিআরটিএ ভবন। এতে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল মেট্রোরেল ও বিআরটিএ সেবা। সবশেষ ডিসেম্বরে জোড়াতালিতে চালু হয়েছে ঢাকা বিআরটি সড়ক।
চলতি বছরও আলোচনায় ছিল সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ ঝরার পাশাপাশি পঙ্গুত্ববরণ করেছেন অনেকে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সড়কে ৬ হাজার ৪শ’ ৭৪টি দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৯৯ জনের প্রাণ ঝরেছে। এছাড়া আহত হয়েছেন ১১ হাজার ৬১ জন। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ২০ জনের প্রাণ ঝরেছে সড়কে। নিহতের বড় অংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হয়েছে। সড়কে বাস-ট্রাক-প্রাইভেটকারের ত্রিমুখী সংঘর্ষ, অটোরিকশা-ইজিবাইক দুর্ঘটনায়ও প্রতিদিনই অনেকের প্রাণ ঝরছে।
গত বৃহস্পতিবার সকালেও নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ সড়কে ট্রাক ও যাত্রীবাহী সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে স্বামী-স্ত্রীসহ ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, অটোরিকশার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় ট্রাকের। অটোরিকশায় চালকসহ ছয়জন ছিলেন। ঘটনাস্থলে দু’জন মারা যান। বাকিদের উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক আরও দু’জনকে মৃত ঘোষণা করেন। একই দিন রাজধানীর সচিবালয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে রাস্তা পারাপারের সময় ট্রাকচাপায় এক ফায়ার সার্ভিস সদস্য নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও একজন। নিহতের নাম মো. সোহানুর জামান নয়ন (২৮)। তিনি তেজগাঁও ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে কর্মরত ছিলেন।
এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় নাচোল পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র মো. মূসা মিয়া (৬৫) নিহত হয়েছেন একই দিনে। তিনি নাচোল উপজেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য। গত বৃহস্পতিবার সকালে জেলা সদর উপজেলায় নাচোল-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। প্রতিদিনই রাজধানীর সড়কসহ আঞ্চলিক সড়কগুলোতে দুর্ঘটনা বাড়ছে। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা ও না মানা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও তদারকি এবং চাঁদাবাজির মতো ঘটনাগুলোকে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করে আসছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
দ্রুতগতির মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আর মোড়ে মোড়ে ফ্লাইওভার থাকা সত্ত্বেও শৃঙ্খলা ফেরেনি ঢাকায়। শৃঙ্খলা ফেরাতে চালু হওয়া ‘নগর পরিবহন’ সেবাও মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাসের ভাড়া নৈরাজ্য কমাতে ই-টিকেটিং পদ্ধতি হলেও তা গায়েব হয়েছে বছরের শুরুতেই। সড়কের বাস স্টপেজ, যাত্রী ছাউনিও ছিল পরিত্যক্ত। সরকার পতনের পর সড়কের বিশৃঙ্খলা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। রাজধানীর সড়ক-মহাসড়কে অবৈধ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় সয়লাব হয়েছে। পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো থেকেও লাখ লাখ অটোরিকশা ঢুকে পড়েছে ঢাকায়। ট্রাফিক পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে ভিআইপি সড়ক, ফ্লাইওভারসহ উল্টোপথেও চলেছে এসব যানবাহন। অবৈধ যানবাহন নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিলেও চালকদের আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে প্রশাসন। এখনও ঢাকার সড়কে দেদারছে ঘুরছে অটোরিকশা। গত ৫ই আগস্টের পর সড়কের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। বেড়েছে যানজট ও আইন না মানার প্রবণতা। এতে বেড়েছে দুর্ঘটনা ঝুঁকিও। আগস্টে ট্রাফিক পুলিশের স্বল্পতায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে শিক্ষার্থীরাও নেমেছেন সড়কে। এছাড়া গত ৫ মাসে বিভিন্ন দাবি নিয়ে সড়ক- রেলপথ অবরোধ করেছেন আন্দোলনকারীরা। ঢাকার শাহবাগ, কাকরাইল, মহাখালী, বনানীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে প্রায়ই অবরোধ করেছেন তারা। এতে যানজটে দুর্বিষহ ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। বছরের শেষদিকে সড়ক অবরোধ কমার পাশাপাশি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনারও কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
মেট্রোরেল, বিআরটিএ, সড়ক ভবনে হমলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ: কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গত জুলাই মাসে মেট্রোরেল স্টেশনে ভাঙচুর, মিরপুরের ফুটওভারব্রিজে অগ্নিসংযোগ, সেতু ও বিআরটিএ ভবনে ভাঙচুরের পাশাপাশি অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা।
এছাড়া মিরপুরের বিআরটিএ’র অফিসেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় ভবনগুলোর। দীর্ঘসময় বন্ধ থাকে মেট্রোরেল ও বিআরটিএ সেবা। গত ১৮ই জুলাই ঢাকার মিরপুর-১০ এলাকায় ব্যাপক সংঘাত হয়। একপর্যায়ে মিরপুর-১০ পুলিশ বক্সে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। ওই আগুন ছড়িয়ে পড়ে ওভার ব্রিজের উপর। সংঘর্ষ চলমান থাকায় তখন মেট্রোরেলের মিরপুর-১০, মিরপুর-১১, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া স্টেশন বন্ধ করে দেয়া হয়। একইদিন বিকাল ৫টার দিকে ডিএমটিসিএল এক বিজ্ঞপ্তিতে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর ৩৭দিন পর্যন্ত বন্ধ থাকে মেট্রোরেল চলাচল। এতে ভোগান্তিতে পড়েন মেট্রোযাত্রীরা। ঢাকায় প্রতিদিনই সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের। পরে ২৫শে আগস্ট ক্ষতিগ্রস্ত মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশন বাদে চালু করে দেয়া হয় মেট্রোরেল। এবং গত ২০শে সেপ্টেম্বর ক্ষতিগ্রস্ত কাজীপাড়া ও ১৫ই অক্টোবর চালু করা হয় মিরপুর-১০ স্টেশন। গত ১৮ই জুলাই রাতে বিআরটিএ কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পরের দিন দুপুর ২টার দিকেও ফের ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে দীর্ঘদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায় মোটরযান রেজিস্ট্রেশন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ফিটনেস সনদ, মালিকানা পরিবর্তন সংক্রান্ত সেবা। মিরপুর সার্কেল অফিসে অটোমেটিক ফিটনেস সনদের মেশিন পোড়ানোতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষাও বন্ধ হয়।
তৎকালীন বিআরটিএ চেয়ারম্যান গৌতম চন্দ্র পাল জানিয়েছিলেন, কার্যালায়ের নিচতলায় রিসিপশন, হেল্পডেস্ক ভাঙচুর করে সিসিটিভি সিস্টেম নষ্ট করে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু কর্নার, লিফট ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগ ঘটানো হয়। পরে বেজমেন্টে গিয়ে ৭টা গাড়ি ও ৫টা মোটরসাইকেলে আগুন দেয়া হয়। গৌতম চন্দ্র পাল বলেছিলেন, দুর্বৃত্তরা প্রত্যেকটা ফ্লোরে ফ্লোরে আগুন দেয়। এভাবে ৫তলা পর্যন্ত আগুন দেয়। এতে আমাদের অবকাঠামো, সরঞ্জাম, আসবাবপত্র আগুনে পুড়ে যায়। বৈদ্যুতিক পুরো সিস্টেম পুড়েছে। সার্ভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেন্দ্রীয় এসি সিস্টেম পুড়ে গেছে। পানির সাপ্লাই সিস্টেম পুড়েছে। এ ছাড়া আমাদের অনেক ল্যাপটপ, কম্পিউটার, প্রিন্টার, ফটোকপি মেশিন, এলইডি মনিটর, টিভি লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়। এক মাস বন্ধ থাকার পুনরায় বিআরটিএ’র সেবা চালু হয় গত আগস্টে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরে।
আন্দোলনকারীদের ডাকে সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ চলার সময় গত ১৮ ও ১৯শে জুলাই বনানীর সেতু ভবনে হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়। হামলার সময় সেতু ভবনের সামনে থাকা যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় নিচতলাসহ কয়েকটি ফ্লোর। সেসব ফ্লোরে ভাঙচুর চালায় হামলাকারীরা। তখন সেতু বিভাগ জানায়, এই হামলায় ৫৫টি গাড়ি পুরোপুরি পুড়েছে। এছাড়া ভবনের নিচতলায় বঙ্গবন্ধু কর্নার, অভ্যর্থনা কেন্দ্র, মিলনায়তন, ডে-কেয়ার সেন্টার পুড়েছে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই বছরের শেষ দিকে জোড়াতালি দিয়ে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পে বাস পরিবষেবা চালু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পে নিজস্ব কোম্পানির বাস চলার কথা থাকলেও চালানো হয়েছে বিআরটিসি’র ১০টি এসি বাস। এছাড়া প্রকল্পের ৫টি স্টেশনের কোনোটিরই কাজ এখনো শেষ হয়নি। গাজীপুরবাসীর ভোগান্তি কমাতে এই বিআরটি সড়ক চালু করার কথা জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
বিজয় দিবস উপলক্ষে ১৬ই ডিসেম্বর সকালে গাজীপুর জেলা শহরের শিববাড়ী মোড়ের বিআরটি স্টেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে গাজীপুর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত বিআরটি লেনে বিআরটিসি বাস চলাচলের উদ্বোধন করেন সড়ক উপদেষ্টা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাসভিত্তিক দ্রুত গতির পরিবহন বিআরটি। এর জন্য বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু তার বদলে বিআরটিসি বাস নামানো এক ধরনের ‘তামাশা।’
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, এই ধরনের তামাশা অন্তত লজ্জাজনক। র্যাপিড বলার জন্য তারা ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। দ্রুত গতি তৈরি করার জন্য এত বিনিয়োগ হলো কিন্তু এখন সেই বিনিয়োগের সঙ্গে র্যাপিড কথাটা নেই। কারণ এখন চলবে সাধারণ বাস। এই বাস তো র্যাপিড হয় না। এটা বিআরটি’র ক্যারেক্টার হয়নি। এটা হবে বাংলা বিআরটি।
আপনার মতামত জানানঃ