নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি, একবার সচিবালয়ের এক উপসচিবের কাছে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সমপদমর্যাদার কর্মকর্তাসহ একটা ফাইল নিয়ে যাই। তাঁর কাজ শুধু ফাইলটি ফরোয়ার্ড করা। উপসচিবের কথা ছিল, রেখে যান ফাইল, তিন দিন পর আসেন। যখন বললাম, স্যার, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কথা ছিল, আমি যদি সঙ্গে সঙ্গে স্বাক্ষর করে দিই, সবাই তো মনে করবে আমার হাতে কাজ নেই। এরপর যখন যাই, ফাইল আর খুঁজে পাওয়া যায় না। পিয়নকে টাকা দিয়ে সেই ফাইল উদ্ধার করতে হয়েছিল। আমি নিশ্চিত এমন অভিজ্ঞতা আরও অনেকেরই রয়েছে।
আমি এখনো জানি না, কেন একটা চিঠি জমা দিলে তা নিচ থেকে ওপরে সবার স্বাক্ষর নিয়ে উঠে আবার ওপর থেকে নিচের ডেস্কেই আসে, মাঝে চার থেকে পাঁচটি দিন হারিয়ে যায়?
ডিজিটাল–স্মার্টের যুগে সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে মেইল করলেও ফোন দিয়ে জানাতে হয়। তারপর আবার হার্ড কপিও দিয়ে আসতে হয়। এখনো বেশির ভাগই ব্যবহার করেন জিমেইল। এত খরচ করে সরকারিভাবে ডোমেইনগুলো যে বানানো হয়েছে, সেগুলা কোথায়? ই-টেন্ডার শুধু নামেই আছে বা অনলাইন ভূমি অফিসের আবেদন পয়সা ছাড়া কারও অনলাইনে হয়েছে, তা সমীক্ষা করে খুঁজে দেখা লাগবে।
কাজ করুক বা না করুক, ঘুষ খাক না না খাক সরকারি অফিসের লোকজনের পে স্কেল থাকবেই। জীবনযাত্রার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এমন দাবি অসংগতিপূর্ণ নয়। কিন্তু ২০১৫ সালেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল আর পে কমিশন হবে না। যুক্তিযুক্তভাবে তাঁদের মূল্যস্ফীতি সমন্বয়ের কথা বলা হয়েছিল। এখন এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার দায় কার? শুধু কি ক্ষমতাসীনদের? রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনকারী হিসেবে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা–কর্মচারীদেরও কি নয়? এখন সরকার ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত ব্যর্থতার জন্য কয়জন মানুষকে দায়ী করা হয়েছে? অথচ তাঁদের কারণে শাস্তি পাচ্ছে পুরা দেশের মানুষ।
অস্ট্রেলিয়াতে অল্প কয়েকজন সচিব পুরো দেশ চালান, আমাদের কেন মাথাভারী প্রশাসন লাগবে? পদের বিপরীতে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার কী মানে আছে? তাঁরা দাবি করেন, তাঁদের মাঠের অভিজ্ঞতা বেশি। তাহলে স্বাস্থ্যের সচিব কেন একজন চিকিৎসক হন না? কৃষি বিষয়ে পড়াশোনা করে আমলা হওয়া ব্যক্তির কী কাজ মহাকাশ গবেষণার প্রতিষ্ঠানে? এ রকম বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে।
যে কোটা নিয়ে এত আন্দোলন, সেখানে উপসচিব থেকে পদোন্নতির জন্য তাঁদের ৫০ শতাংশ কোটাও কম হয়ে যায়। হবেও না কেন? এরপর তো নানা সুযোগ–সুবিধার শেষ নেই। রাষ্ট্রই সে ব্যবস্থা করে রেখেছে। আর কে না জানে, রাষ্ট্র মানে আবার তাঁরা নিজেরাই। সরকার গাড়ি দেবে, ঋণ দেবে। জেলা প্রশাসকের স্ত্রী বা পুলিশ সুপারের স্ত্রীরাও বিভিন্ন জায়গায় প্রটোকল পান, পদাধিকারবলে বিভিন্ন কমিটিতে ঢুকে যান। ফেসবুকে তাঁদের সঙ্গে ছবি তুলতে পারলে বন্ধু–আত্মীয়স্বজনের জীবন ধন্য হয়ে যায়।
এখন দেখা যাচ্ছে, উপসচিব থেকে পদোন্নতির জন্য তাঁদের ৫০ শতাংশ কোটাও কম হয়ে যায়। হবেও না কেন? এরপর তো নানা সুযোগ–সুবিধার শেষ নেই। রাষ্ট্রই সে ব্যবস্থা করে রেখেছে। আর কে না জানে, রাষ্ট্র মানে আবার তাঁরা নিজেরাই। সরকার গাড়ি দেবে, ঋণ দেবে। জেলা প্রশাসক বা পুলিশ সুপারের স্ত্রী–সন্তানেরাও বিভিন্ন জায়গায় প্রটোকল পান, পদাধিকারবলে বিভিন্ন কমিটিতে ঢুকে যান। ফেসবুকে তাঁদের সঙ্গে ছবি তুলতে পারলে বন্ধু–আত্মীয়স্বজনের জীবন ধন্য হয়ে যায়।
এ সব কারণে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বাড়ানোর সঙ্গে নিজেরাও নিজেদের বয়সসীমা বাড়ানোর নোট ধরিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করেন না। উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডার থেকে কোটা ভিত্তিতে তারা সবচেয়ে বেশি শতাংশ পদোন্নতি পেয়ে থাকেন এবং সেটির বহাল চান তাঁরা। চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে গোটা একটা স্বৈরাচারী সরকার পড়ে গেল, এরপরও কীভাবে নিজেদের জন্য এমন ব্যবস্থা রাখতে চান তাঁরা? এটা অন্যদের প্রতি চরম বৈষম্য।
অন্তর্বর্তী সরকারের দু–একজন উপদেষ্টার সঙ্গে গল্পচ্ছ্বলে জানতে পারি, তাঁদের সব ইচ্ছা–চেষ্টা স্থবির হয়ে যায় তাঁদের নিচের মানুষদের জন্য। এই যদি হয় অবস্থা, সেখানে দেশের উন্নয়ন কীভাবে দ্রুত হবে তাঁদের দিয়ে? আর আগের ফ্যাসিবাদী সরকারের সব প্রকল্পের দুর্নীতি ও অনিয়মের দায়ভারও কেন আমলারা নেবেন না? এ বিষয়গুলোর বিষয়ে জনপ্রশাসন সংস্কারের কমিশন কী বলবে?
আরও পড়ুন
এ কমিশনের প্রস্তাবনায় যুগান্তকারী কিছু শোনা যাচ্ছে না। হবেই–বা কী করে? এ কমিশনের শুরুতে সবাইকে নেওয়া হয়েছিল প্রশাসন ক্যাডার থেকে। পরে প্রতিবাদের কারণে দুজন অন্য ক্যাডার থেকে আসেন। এখানে ভুক্তভোগীই কেউ তো নেই যে বলবেন ‘রাজার গায়ে পোশাক নাই’। আগের সব সংস্কার প্রস্তাবের বড় বড় বই লাইব্রেরিতে পাবেন, খুঁজলে অনলাইনেও পেতে পারেন। ১৯৭২ সাল থেকে ১২টি কমিশন বা কমিটি হয়েছে। কিন্তু কোনোটিরই বাস্তবায়ন হয়নি।
এখন সংস্কার কীভাবে হবে? সবচেয়ে বড় বিষয় মাথাভারী জনপ্রশাসন থাকতে দেওয়া যাবে না। তাঁদের সংখ্যা কমাতে হবে। আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর করতে হবে; ক্যাডার–ননক্যাডার বৈষম্যও। নিজ নিজ সার্ভিসের মানুষ দিয়ে সেই সার্ভিস চালাতে হবে। সবার ‘অফুরন্ত’ সুবিধা কমাতে হবে। সব কাজের একটা সময় বেঁধে দিতে হবে। সব বিভাগে নিজস্ব মানবসম্পদ বিভাগ ঠিক করতে হবে। ব্যাচ ধরে নয়, পারফম্যান্স অনুসারে পদোন্নতি বা মূল্যায়ন করতে হবে।
সরকারি চাকরি যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই—এ বাস্তবতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। পারফম্যান্স সন্তোষজনক না হলে, অনিয়ম–দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকলে অভিযোগের ভিত্তিতে ছাঁটাই করার বিষয়গুলো আরও সহজ করতে হবে। চাকরির নিরাপত্তার বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে এদিকেও গুরুত্বের সঙ্গে নজর দিতে হবে।
প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। সবার ঢাকায় থাকতে চাওয়ার প্রবণতার অবসান হওয়া চাই। এ ছাড়া দলীয়করণ থেকে মুক্ত রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এটা নিশ্চিত করতে হবে। সবাইকে জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। সব জায়গায় প্রশাসন ক্যাডার থেকে ডেপুটেশনে দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
বিসিএস পরীক্ষার পদ্ধতি বদলাতে হবে, আনতে হবে অ্যানালিটিক্যাল প্রশ্ন, যাতে মেধাবীদের জন্য অবাধ সুযোগ তৈরি করতে পারে। সবাইকে প্রযুক্তিনির্ভর করে আগের চেয়ে গতিশীল করতে হবে। মাঝের পজিশনগুলোয় বেসরকারি থেকে নিয়োগের ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাহলে অন্তত স্থবির প্রশাসন আমরা ভবিষ্যতে দেখতে পাব না।
আজ পর্যন্ত জনপ্রশাসনের কেউ দেশ ও মানুষের কল্যানে কোনো দাবি নিয়ে জোট বেঁধেছেন এমন নজির দেখা যায়নি। কিন্তু সংস্কার প্রস্তাবে নিজেদের ‘গুড়’ কমে যাবে দেখে ইতিমধ্যে সবাই একজোট হয়েছেন। এখানে স্বৈরাচারের পক্ষে–বিপক্ষে সবাই এক। সরকার সংস্কার কমিশন করেছে, কমিশন তার মতো কাজ করবে, প্রতিবেদন দেবে, তা বাস্তবায়নের বিবেচনা সরকারের। কিন্তু তার আগেই সরকারি কর্মকর্তারা একজোট হয়ে যা করছেন, তাতে বোঝা যায়, তাঁরা নিজেরাই জনপ্রশাসনের সংস্কার চান না।
বদলের পথে বাধা আসবেই। আর সেই বাধা সরাতে না পারলে ভবিষ্যতে ১৯৯৬ সালের মতো জনতার মঞ্চ করে ক্ষমতাবদলে সহযোগিতা করা বা ২০১৪, ২০১৮ বা ২০২৪ সালের মতো ফ্যাসিস্ট সরকারকে সহযোগিতা করার আশঙ্কা থেকেই যাবে।
আপনার মতামত জানানঃ