আগামী বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই তুলে দেওয়ার ‘আশার বাণী’ শোনালেও সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে পাঠ্যবই মুদ্রণ তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
সংস্থাটি এখন বলছে, ৪০ কোটি ১৬ লাখ বইয়ের সবগুলো জানুয়ারির শেষ দিকে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো সম্ভব হবে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন তুলে ধরে ছাপাখানা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফেব্রুয়ারির আগে বই সব শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেওয়া কঠিন হবে। এজন্য শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন, পাণ্ডুলিপি দেরিতে পাওয়াসহ নানা কারণ তুলে ধরেন তারা।
এতে করে বছরের প্রথম মাসেই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার যে প্রচলন ছিল বিগত বছরগুলোতে তাতে এবার ছেদ পড়তে যাচ্ছে।
ছাপাখানা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ফেব্রুয়ারির আগে শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই তুলে দেওয়া যাবে না বলে ধারণা পাওয়া গেছে। বই পরিমার্জন হয়ে ছাপাখানায় যেতেই পাঁচ মাস দেরি হয়েছে এবার। রাজধানীর কয়েকটি ছাপাখানা ঘুরে নিশ্চিত হওয়া গেছে প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ চললেও মাধ্যমিকের বই ছাপার কাজ শুরুই হয়নি।
এমন প্রেক্ষাপটে বছরের শুরতেই শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই পৌঁছানো সম্ভব হবে না বলে স্বীকার করেছেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসানও।
তিনি বলেন, “বই পৌঁছাতে কিছুটা দেরি হলেও তা ফেব্রুয়ারিতে যাবে না। আশা করছি, ২০ জানুয়ারির মধ্যে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো সম্ভব হবে।”
নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল করে পুরনো শিক্ষাক্রমে ফেরার ঘোষণা আসে গত সেপ্টেম্বরের প্রথম দিন। এনসিটিবি বলেছিল, ২০১২ শিক্ষাক্রমের বইগুলো পরিমার্জন শেষে ছাপানো হবে এবং রীতি অনুযায়ী জানুয়ারির শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হবে।
সাধারণত জুনে নতুন বছরের বইগুলোর পাণ্ডুলিপি ছাপাখানায় পাঠানো হয়। কিন্তু ৫ অগাস্টের পটপরিবর্তনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৩ সালে বাস্তবায়ন শুরু হওয়া ‘অভিজ্ঞতা নির্ভর শিক্ষাক্রম’ বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে ঘোষণা দেয়। ফলে এক যুগ আগে ২০১২ সালে প্রণীত শিক্ষাক্রমের বই ‘ঘষে-মেজে’ নভেম্বরে প্রেসে পাঠানো শুরু হয়।
গত কয়েক বছর পাঠ্যবইয়ের একাংশ ভারতেও ছাপা হত। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরের বাস্তবতায় এবার শুধু দেশি ছাপাখানাগুলো বই ছাপার কাজ করছে।
ছাপাখানা মালিকদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, মাধ্যমিকের বইয়ের কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে তদারকি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন পেতেই দেরি হয়েছে। এরপর কাগজ সংকট, বিদ্যুৎ না থাকা এবং ব্যাংক ঋণ না পাওয়াসহ কয়েকটি কারণে ছাপার কাজে অগ্রগতি আশানুরূপ নয়।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আনোয়ার হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এখনও তদারকি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মাধ্যমিকের বই ছাপার অনুমোদন নিতে পারিনি।
“কাজ যে করব সারাদিন বিদ্যুৎ থাকে না। রাতের দিকে কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায়। আমরা ব্যাংক লোন নিয়ে কাজ করি। কিন্তু এবার লোন পেতেও ভোগান্তি হচ্ছে। এরপর রয়েছে কাগজ সংকট। মাধ্যমিকের বইয়ের কাজ সবগুলো প্রেস একসঙ্গে শুরু করতে চাচ্ছে। তাই এ কাজের জন্য যে কাগজ দিতে হবে সেটির সংকট দেখা দিয়েছে।”
কবে নাগাদ সব বইয়ের কাজ শেষ হবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আসলে থিউরিটিক্যালি জানুয়ারিতে কাজ শেষ হবে বলা গেলেও বাস্তবতা কঠিন। সব বইয়ের কাজ শেষ হতে জানুয়ারি মাস চলে যাবে। তাই ফেব্রুয়ারির আগে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না।”
তিনটি বইয়ের কাজ অগ্রাধিকারভিত্তিতে শেষ করতে বলার তথ্য দিয়ে আনোয়ার হোসাইন বলেন, “মাধ্যমিক পর্যায়ের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই আগে শেষ করতে বলেছে এনসিটিবি। আমরা সে বইগুলোর কাজ আগে শেষ করে পাঠিয়ে দেব।”
‘লেটার এন কালার’ নামের একটি ছাপাখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ সিরাজ উদ্দিন বলেছেন, প্রাথমিকের বই ছাপানোর কাজ চলছে। মাধ্যমিকের বই ছাপানোর কাজ শুরুই করা যায়নি। কারণ হিসেবে তিনি এখনও তদারকি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন না পাওয়ার কথা বললেন।
“ছাপার কাজ শুরু করা গেলেও কাগজের সংকট আছে। এনসিটিবি যে মানের কাগজ চায় সে কাগজ সংগ্রহে বেগ পেতে হচ্ছে। আবার মান সঠিকভাবে মানা না হলে বই বাতিল হয়ে যাবে।”
কবে নাগাদ বই ছাপার কাজ শেষ করা সম্ভব হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সব কাজ শেষে হতে ফেব্রুয়ারি মাস চলে আসবে। এর আগে বইয়ের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না।”
পাঠ্যবই মুদ্রণের মান তদারকিতে এনসিটিবি ও ছাপাখানাগুলোর মধ্যে একটি তৃতীয় তদারকি কোম্পানি কাজ করে। এনসিটিবি নিয়োজিত দুটি কোম্পানি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বই ছাপতে ছাপাখানাগুলোতে ব্যবহৃত কাগজ ও আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি ‘মানসম্মত’ কি না তা যাচাই করে দেখে। তাদের অনুমোদন পাওয়ার পরে ছাপার কাজ শুরু করে ছাপাখানাগুলো।
চলতি বছর ‘ব্যুরো ভেরিটাস’ নামের একটি কোম্পানিকে মাধ্যমিক পর্যায়ের বই তদারকির দায়িত্ব দিয়েছে এনসিটিবি। প্রাথমিক পর্যায়ের বই তদারকির দায়িত্ব পেয়েছিল ‘ফিনিক্স’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক রিয়াজুল বলেন, “মাধ্যমিকের বইয়ের মুদ্রণ তদারকি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে নিয়োগ হয়েছে। ব্যুরো ভেরিটাস নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ কাজ পেয়েছে। প্রেসগুলোর পক্ষ থেকে এনসিটিবিতে আসলেই তারা মাধ্যমিকের বই ছাপানোর অনুমোদন পেয়ে যাবেন।
“আর প্রাথমিকের বইয়ের মান তদারকিতে ফিনিক্স নামের যে প্রতিষ্ঠানটি কাজ পেয়েছে তাদের অনুমোদনের কাজ শেষ। তারা প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন করছে।”
আপনার মতামত জানানঃ