ভুয়া বিল ভাউচারের নামে অর্থ লুটপাটকে দৃষ্টির আড়ালে রাখতেই বই উৎসবের আয়োজন করেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। বছরের শুরুতে শতভাগ বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে না পারলেও উৎসবের আনন্দে যেন সবকিছু ভুলিয়ে রাখা হতো সবাইকে। আর উৎসবের নামে যে অর্থ খরচ করা হতো তার যোগান দেয়া হতো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতর ও শিক্ষা বোর্ড থেকে। সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে পরিচালিত এক অনুসন্ধানে জানা গেছে ভুয়া বিল ভাইচার দিয়েই বই উৎসবের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট করা হয়েছে।
গণমাধ্যমের হাতে আসা কয়েকটি বিল ভাউচারের কপি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে ২০২১ সালের পর ২০২২ সালেই মাত্র এক বছরের ব্যবধানে হল ভাড়া বাবদ ব্যয় ১০ লাখ টাকা বেশি দেখানো হয়েছে। ২০২১ সালের বই উৎসবে ঢাকার একটি হল ভাড়া বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৭ লাখ ৬২ হাজার ৩০০ টাকা। কিন্তু এক বছর পরেই ২০২২ সালে ওই একই হলের ভাড়া অবাস্তব ও অবিশ্বাস্য হলেও দেখানো হয়েছে ১৬ লাখ ৯৩ হাজার ৬২ টাকা। বিশেষ করে ২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই চার বছরে শুধু এনসিটিবি থেকেই ১৫ টি বিলের মাধ্যমে ৭৩ লাখ ২১ হাজার তিন টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে বই উৎসবের আড়ালে শুধু আপ্যায়ন বাবদই ব্যয় দেখানো হয়েছে ১৩ লাখ ৯ হাজান ১৯ টাকা। আবার ২০২২ সালে বই উৎসবের অনুষ্ঠানস্থলে ইন্টারনেট সংযোগ ও বিল বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে চার লাখ বিশ হাজার টাকা। ঢাকার কাজলা টেকনোলজি নামে একটি কোস্পানি বরাবরে এই বিল পরিশোধ করা হয়েছে। একই বছরে ইভেন্টকম নামে একটি কোম্পানিকে হল ভাড়া ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট বাবদ নগদ অর্থ দেয়া হয়েছে ১৬ লাখ ৯৩ হাজার ৬২ টাকা। ২০২৩ সালের বই উৎসবের ছবি ও ভিডিও ধারণের জন্য ব্যয় দেয়ানো হয়েছে দুই লাখ ৫৫ হাজার টাকা। সূত্র জানায়, ২০২১ সালে হল ভাড়া বাবদ ৭ লাখ ৬২ হাজার ৩০০ টাকা খরচ দেখানো হলেও একই বছরের একই অনুষ্ঠানে ২০৬৫ নং ভাউচারে খরচের খাত উল্লেখ না করেই এশিয়াটিক ইভেন্ট মার্কেটিং লিমিটেডের বরাবরে ব্যয় দেখানো হয়েছে বিশ লাখ ৭৩ হাজার ৯৯৪ টাকা।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, বিভিন্ন বিল ভাউচারের মধ্যে কিছু বিলের খাত উল্লেখ না করেই অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে। যেমন ভাউচার নং ১০৪৫ এর মাধ্যমে চার লাখ ৯৮ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হলেও খরচের কোনো খাত উল্লেখ করা হয়নি। খরচের এই টাকা সারোজ ক্রিয়েটিভের অনুকূলে ব্যয় দেখানো হয়েছে। ১৬৯০ নং বিলে হল ভাড়া বাবদ সাত লাখ ৬২ হাজার ৩০০ টাকা বাংলাদেশ সার্ভিস লিমিটেডের বরাবরে ব্যয় দেখানো হয়েছে। ২০২৩ সালের বই উৎসবে ২০২৬ নং বিলে ৯ হাজার ২৫৬ টাকা আপ্যায়ন বাবদ, ৯৬৭ নং বিলে দাওয়াত কার্ড বাবদ ৩৬ হাজার টাকা, ৯৭০নং বিলে গাড়ি ভাড়া ৩৫ হাজার টাকা, ১০৮৩ নং বিলে পাটের ব্যাগ কেনা বাবদ মা জুট প্রোডাক্সটকে পরিশোধ করা হয়েছে এক লাখ ৪৪ হাজার ৯০০ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু এনসিটিবির নিজস্ব তহবিল থেকেই এই বিশাল অঙ্কের টাকা বই উৎসবের নামে লোপাট করা হয়েছে। এর বাইরেও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি), প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড, জেলা শিক্ষা অফিস, উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকেও বিভিন্ন খাত উপখাতের বরাদ্দ থেকে অর্থ নিয়ে প্রতি বছর জানুয়ারির প্রথম দিনে বই উৎসবের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এইসব অর্থ লোপাটের খতিয়ান তলব করা হয়েছে। পুরো তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ হওয়া জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসব বিষয়ে গতকাল রোববার এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান নয়া দিগন্তের এই প্রতিবেককে বলেন, বিগত সময়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট করা হলেও প্রকৃত অর্থে বছরে প্রথম দিনে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হতো না। শুধু অনুষ্ঠান আর উৎসবের আনন্দেই শিক্ষার্থীদের সবকিছু ভুলিয়ে রাখা হতো। এটাই ছিল তখনকার একটি কৌশলও বটে। চেয়ারম্যান আরো বলেন, বছরের প্রথম দিনে সব শিক্ষার্থীকে সব বই দেয়া সম্ভব না হলেও নতুন বই হাতে পেতে শিক্ষার্থীদের খুব বেশি অপেক্ষা হয়তো করতে হবে না। আমরা বইয়ের মান নিয়ে এ বছর কোনো ছাড় দিচ্ছি না। এ বিষয়টিকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আমরা এখনো আশা করছি প্রাথমিকের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা বছরের প্রথম দিনেই বই হাতে পাবে। আর চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা ইংরেজি ও গণিত বই আগে পাবে। মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরাও প্রধান তিনটি বই আগেই পাবে। এরপর পর্যায়ক্রমে জানুয়ারি মাসের মধ্যেই তারাও সব বই হাতে পাবে।
আপনার মতামত জানানঃ