ইউক্রেনের রাজধানী কিভ থেকে চেরনোবিলের পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রের দূরত্ব খুব বেশি নয়। সম্প্রতি ‘চেরনোবিল এক্সক্লুশন জোন (সিইজেড)’-এ বসবাসকারী পথকুকুরদের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। আর সেই রক্ত পরীক্ষা করেই চাঞ্চল্যকর তথ্য হাতে এসেছে তাদের হাতে।
পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এক্সক্লুসন জ়োনে কুকুরের এমন দু’টি প্রজাতি দেখতে পাওয়া গিয়েছে, যার জিনের গঠন অন্যান্য কুকুরের থেকে আলাদা। সেই কুকুরগুলিকে ‘সুপারডগ’ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, চেরনোবিলের বিষাক্ত পরিবেশে মানিয়ে নিয়েছে ওই কুকুরগুলি। দীর্ঘ সময় ধরে তেজস্ক্রিয়তার মধ্যে বসবাসের কারণে তাদের জিনের গঠনও বদলেছে। অনন্য ‘সুপারডগ’-এ পরিণত হয়েছে তারা।
কেন ওই কুকুরগুলিকে ‘সুপারডগ’-এর তকমা দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা? তাঁরা জানিয়েছেন, ওই কুকুরগুলির উপর পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে, তাদের শরীর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ রোধ করতে সক্ষম। রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি।
কিন্তু কী করে এমনটা হল? ১৯৮৬ সালে দু’-দু’টি ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রটির পরমাণু চুল্লি।
সেই বিস্ফোরণে চুল্লির উপরের প্রায় দু’হাজার টন ওজনের ধাতব ঢাকনা উড়ে যায়। তার পর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে লাগোয়া এক হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকায়। বন্ধ করে দেওয়া হয় পারমাণবিক কেন্দ্রটি।
ওই প্লান্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণে তেজস্ক্রিয় পদার্থ বার হতে থাকে। হাওয়ার দাপটে তা ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের ১৩টি দেশে।
তেজস্ক্রিয়তার জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হন ছ’লক্ষ মানুষ। তার মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান প্রায় চার হাজার মানুষ। মানব ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় তেজস্ক্রিয় নির্গমণের ঘটনা।
বিকিরণের ছোবল থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রের বাইরে বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা হয় ‘এক্সক্লুসন জ়োন’। সেই সময়েই বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ২৪ হাজার বছর ওই এলাকা আর মানুষের বসবাসের পক্ষে উপযোগী করে তোলা সম্ভব হবে না।
আগামী দিনে যাতে পারমাণবিক বর্জ্য থেকে বিপদের সঙ্কেত লাগোয়া এলাকাগুলিতে আগেভাগেই মেলে, তার জন্য শুরু হয় ‘এক্সক্লুসন জ়োনে’ নিয়মিত বিকিরণ মাপার কাজ।
চেরনোবিলের ওই এলাকায় রয়েছে একটি স্বয়ংক্রিয় তেজস্ক্রিয় বিকিরণ মাপক ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে ‘এক্সক্লুসন জ়োনে’ গামা রশ্মিসহ বিভিন্ন ধরনের তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাত্রা ঘণ্টায় ঘণ্টায় মাপা হয়।
চেরনোবিলের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর ওই এলাকা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হলেও বহু গৃহপালিত পশু, পথকুকুর এবং অন্য বন্যপ্রাণীরা সেখানেই রয়ে যায়। তাদের মধ্যে কিছু কুকুরের উপরেই পরীক্ষা করে দেখেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীদের মতে, দীর্ঘ দিন তেজস্ক্রিয় বাতাস সেবন করে ‘সুপারডগে’ পরিণত হয়েছে পথকুকুরগুলি। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের কারণে তাদের শরীরের খোলনলচে বদলে গিয়েছে।
বিজ্ঞানীদের ওই দল জানিয়েছে, তেজস্ক্রিয় পরিবেশে থাকলে প্রাণীদের উপর কী প্রভাব পড়ে তা বুঝতে অনেকটাই সাহায্য করেছে এই পরীক্ষা। এবং শুধু কুকুরের জন্য নয়, অত্যন্ত বিষাক্ত এবং দূষিত পরিবেশে বসবাসের কারণে মানুষের উপরেও কী প্রভাব পড়তে পারে তা বোঝার জন্যও ওই পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।
চেরনোবিল ‘এক্সক্লুসন জ়োনে’ বসবাসকারী কুকুরেরা দীর্ঘ দিন বিষাক্ত পরিবেশে বেঁচে রয়েছে। এই অঞ্চলে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাত্রা সহ্য করার ক্ষমতা মানুষের তুলনায় তাদের ছ’গুণ বেশি। তা সত্ত্বেও প্রায় ৯০০ পথকুকুর সেই বিষাক্ত পরিবেশে বাস করছে। এর মধ্যে অনেক কুকুর ফেলে রেখে যাওয়া পোষ্য কুকুরদের বংশধর।
সংবাদমাধ্যম ‘ডেলি মেল’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরিবেশের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গবেষক কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী নরম্যান জে ক্লেম্যান এবং তার দল ২০১৮-’১৯ সালে সেই কুকুরগুলির রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেন।
নমুনাগুলি পরীক্ষা করার জন্য আমেরিকায় পাঠানো হয়। সেখানে এক পরীক্ষাগারে কুকুরগুলির ডিএনএ বিশ্লেষণ করা হয়। দীর্ঘ গবেষণার পরে বিজ্ঞানীরা বুঝতে সক্ষম হন যে, বিষাক্ত পরিবেশ কুকুরগুলির জিনের গঠনে কী প্রভাব ফেলেছে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কুকুরগুলির এমন ৪০০টি জেনেটিক অবস্থান রয়েছে, যা স্বাভাবিকের থেকে আলাদা। এই জিনগুলিই তাদের বিষাক্ত পরিবেশে বেঁচে থাকার উপযোগী করে তুলেছে।
কুকুরগুলির মধ্যে নাকি নতুন জিনের দেখাও মিলেছে। বিজ্ঞানীরা এমন ৫২টি জিন শনাক্ত করেছেন, যা বিষাক্ত এলাকায় বসবাসের কারণে বিবর্তিত হয়েছে। সেই জিনগুলি এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বাহিত হয়েছে। আর সে জন্যই তেজস্ক্রিয় বিকিরণ, ভারী ধাতু এবং দূষণ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে কুকুরগুলি। ওই কুকুরগুলির মধ্যে যেন বিশেষ ‘সুপার পাওয়ার’ তৈরি হয়েছে।
তবে শুধু কুকুর নয়, ওই এলাকায় বসবাসকারী নেকড়ে এবং ব্যাঙগুলির মধ্যেও নাকি তেজস্ক্রিয় বিকিরণ এবং দূষণ প্রতিরোধের ক্ষমতা তৈরি হয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ