দেশের বৃহৎ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৭১৮ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্টটি নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে অবস্থিত। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য প্রায় এক বছর আগে এটি প্রস্তুত হয়েছে।
এরই মধ্যে দেশের বৃহৎ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৭১৮ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্টটি নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে অবস্থিত। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য প্রায় এক বছর আগে এটি প্রস্তুত হয়েছে। এরই মধ্যে শেষ করেছে আনুষ্ঠানিক সব কার্যক্রমও। এটি নির্মাণে জাপানিজ কোম্পানি জাপানস এনার্জি ফর আ নিউ এরা (জেরা) প্রায় ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা না পাওয়ায় কেন্দ্রটি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে। এদিকে উৎপাদনে না গেলেও চুক্তি অনুযায়ী পরিশোধ করতে হচ্ছে ঋণের কিস্তি।
মেঘনাঘাটের গ্যাসভিত্তিক ৭১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির শুরুতে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ছিল ভারতীয় রিলায়েন্স পাওয়ার। বর্তমানে এর মালিকানা জাপানের বহুজাতিক কোম্পানি জেরা। তাই প্রকল্পটি জেরা মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেড নামে বাস্তবায়ন হচ্ছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে জেরার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্র সম্পাদন হয় বিপিডিবির। চলতি বছরের ২৬ অক্টোবর শেষ হয় পরীক্ষামূলক কার্যক্রমও। চুক্তি অনুযায়ী, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল) এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করবে। এজন্য সংস্থাটির সঙ্গে জিএসএ (গ্যাস সাপ্লাই এগ্রিমেন্ট) সই হয়। কেন্দ্রটি ২২ বছর পিডিবিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। এ কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ক্রয়ে বিপিডিবির ৫ টাকা ৮৪ পয়সা ব্যয় হবে। কিন্তু তিতাস থেকে গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা না পাওয়ায় উৎপাদনে যেতে পারছে না কেন্দ্রটি।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালাতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। সেখানে সরবরাহ হচ্ছে ৮২০-৮৪০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। আর জেরার ৭১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য দৈনিক ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। এ গ্যাসের বাড়তি জোগান এ মুহূর্তে নেই তিতাসের কাছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহনেওয়াজ পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জেরার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এ মুহূর্তে গ্যাস দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। মেঘনাঘাটে গ্যাস সরবরাহের জন্য নতুন গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। সে কাজ শেষ হওয়ার পাশাপাশি নতুন করে গ্যাসের বাড়তি জোগান তৈরি হলে সরবরাহ দেয়া সম্ভব হবে। বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে গ্যাসের বাড়তি সরবরাহের ওপর। এছাড়া বিপিডিবি চাইলে অন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রেশনিংয়ের মাধ্যমে কেন্দ্রটি উৎপাদনে রাখতে পারে।’ জেরাসহ নারায়ণগঞ্জে সামিট ও ইউনিক গ্রুপের মোট তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এগুলোয় গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা চেয়ে গত মাসে বিপিডিবি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, মেঘনাঘাটে স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর থার্মাল ইফিশিয়েন্সি অনেক বেশি। এগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চালু রাখা বিদ্যুৎ সিস্টেমের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে এসব কেন্দ্র চালু থাকলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের আর্থিক সাশ্রয়ও হবে।
একই সময়ে গড়ে ওঠা সামিট ও ইউনিকের দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র অবশ্য বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে। এর মধ্যে ইউনিক গ্রুপের ৫৮৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদনের অনুমতি (সিওডি) পায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে আর সামিটের ৫৮৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সিওডি পায় এপ্রিলে। অথচ একই সময়ে জেরার বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রস্তুত হলেও বাণিজ্যিক উৎপাদনের অনুমতি মেলেনি। গ্যাস সরবরাহের অনুরোধ জানিয়ে জেরার পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ বিভাগ, পেট্রোবাংলা ও তিতাসে একাধিকবার চিঠিও দেয়া হয়। কিন্তু কোনো আশ্বাসই পায়নি কেন্দ্রটি।
বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ অক্টোবর থেকে জেরার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে সপ্তাহব্যাপী উৎপাদনে ছিল। পরীক্ষামূলক উৎপাদনের সময় কেন্দ্রটিতে ১০০-১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবাহ হয়। এ গ্যাস দিয়ে প্রায় ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড করে। বাণিজ্যিক উৎপাদনের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শেষ করে কেন্দ্রটি গত অক্টোবর থেকে বন্ধ রয়েছে। তবে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে না পারলেও বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে নেয়া বিপুল পরিমাণ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে যেতে হচ্ছে মালিকপক্ষকে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জেরা ঋণ নিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনসহ একাধিক জাপানিজ ব্যাংক থেকে। এর মধ্যে তিন কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে। চলতি মাসে পরিশোধের কথা রয়েছে ঋণের চতুর্থ কিস্তি। তাই এখনই কেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে না গেলে বাকি কিস্তি পরিশোধ জেরার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জেরা মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটিডের হেড অব কন্ট্রাক্টস অ্যান্ড কমার্শিয়াল স্মিতেশ বৈদ্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জেরার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশে সবচেয়ে উচ্চ ইফিশিয়েন্সি ও সর্বনিম্ন উৎপাদন খরচের কেন্দ্র। এটি বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। এ কেন্দ্রের সুবিধা হলো কম গ্যাসে বেশি বিদ্যুৎ যেমন উৎপাদন করা যাবে, তেমনি বিপিডিবির খরচও কম পড়বে। তাই প্রয়োজনীয় গ্যাসের জোগান নিশ্চিত করা গেলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে কেন্দ্রটি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।’
ঋণ পরিশোধের বিষয়ে এ কর্মকর্তা জানান, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এডিবি ও জাপানিজ ব্যাংক বিনিয়োগ করেছে। ফলে ঋণ পরিশোধের একটি ব্যাপার রয়েছে। কেন্দ্রটি উৎপাদনে না থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করছে জেরা।
বিপিডিবি ও জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ও ব্যয় সাশ্রয়ী বিবেচনায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে গ্যাস সংযোগ প্রয়োজন। অদক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ না করে বরং বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যয় সাশ্রয় হয় এমন বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো দরকার বিপিডিবির। তাতে বিপিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও কমবে। বিষয়টি স্বীকার করেন বিপিডিবির কর্মকর্তারাও।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদন কস্ট বিবেচনায় গ্যাসভিত্তিক অত্যাধুনিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বিপিডিবির চালানো দরকার। এক্ষেত্রে মেঘনাঘাটে সামিট, ইউনিক ও জেরার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ দেয়া উচিত। এগুলো ইফিশিয়েন্সি ও খরচ সাশ্রয়ী। তাছাড়া এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদেশী বিনিয়োগ রয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগের আস্থা ধরে রাখার ক্ষেত্রে কেন্দ্রগুলোর গুরুত্ব রয়েছে।’
আপনার মতামত জানানঃ