কোয়েলাক্যান্থ ‘ল্যাজারাস ট্যাক্সন’ এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ‘ল্যাজারাস ট্যাক্সন’ হলো এমন প্রজাতি, যা আপাতদৃষ্টিতে জীবাশ্ম রেকর্ড থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং লক্ষ লক্ষ বছর পরে একই আকারে পুনরায় আবিষ্কার করা হয়।
১৯৩৮ সালের আগে আপনি যদি কোনো প্রাণিবিজ্ঞানীকে মানুষের জানা প্রাচীনতম মাছের নাম জিজ্ঞেস করতেন, আপনি সম্ভবত কোয়েলাক্যান্থ নামের এক ধরনের লোব-ফিশের কথা শুনতেন।
মাছের নামটিই কেমন যেন পুরনো ধরনের তাই না! কোয়েলাক্যান্থস প্রথম উৎপত্তি লাভ করেছিল ৪০০ মিলিয়ন বছর আগে ডেভোনিয়ান যুগের প্রথম দিকে।
তবে ১৯৩৮ সালের আগ পর্যন্ত প্রাণিবিজ্ঞানীরা জানতেন না যে প্রাচীনতম এই মাছটি তখনো পৃথিবীর সমুদ্রে পাওয়া যেতে পারে। কারো মুখে এ সম্ভাবনার কথা শুনলেও তারা হয়তো হাসতেন।
১৯৩৮ সালে কোয়েলাক্যান্থের পুনঃআবিষ্কারের আগে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেছিলেন, ৬৫-৭০ মিলিয়ন বছর আগে ক্রিটেসিয়াস যুগের শেষের দিকে কোয়েলাক্যান্থ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
কোয়েলাক্যান্থ ‘ল্যাজারাস ট্যাক্সন’ এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ‘ল্যাজারাস ট্যাক্সন’ হলো এমন প্রজাতি, যা আপাতদৃষ্টিতে জীবাশ্ম রেকর্ড থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং লক্ষ লক্ষ বছর পরে একই আকারে পুনরায় আবিষ্কার করা হয়।
এমনটা বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে। কোয়েলাক্যান্থ পুনঃআবিষ্কারে প্রাণিবিজ্ঞানীরা রীতিমতো ভড়কে গিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ইস্ট লন্ডনের একটি ছোট্ট শহরের যাদুঘরের কর্মচারী মার্জোরি কোর্টেনে-ল্যাটিমারকে (৩২) কেউ একজন এমন একটি মাছ উপহার দিয়েছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার ইস্টার্ন কেপের চালুমনা নদীর মোহনার ঠিক বাইরে মাছ ধরার সময় স্থানীয় এক জেলের হাতে ধরা পড়ে মাছটি।
কোর্টেনে-ল্যাটিমার মাছটি শনাক্ত করতে পারেননি, তাই তিনি এটিকে ট্যাক্সিডার্মিড করেছিলেন এবং অধ্যাপক জেমস লিওনার্ড ব্রিয়ারলি স্মিথ নামের একজন বিশেষজ্ঞের মতামত চেয়েছিলেন। অধ্যাপক জেমস লিওনার্ড ব্রিয়ারলি স্মিথ ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক এবং সামুদ্রিক প্রাণ-প্রকৃতি বিশেষজ্ঞ।
ব্রিয়ারলি স্মিথ ই-মেইলের মাধ্যমে ল্যাটিমারের স্কেচ এবং অজ্ঞাত মাছটি সম্পর্কে তথ্যগুলো পাওয়ার পরই সন্দিগ্ধ হয়ে পড়েন এবং তৎক্ষণাৎ এক টেলিগ্রামে তিনি মাছটির কঙ্কাল ও ফুলকা সতর্কতার সাথে সংরক্ষণ করে রাখতে বলেন।
এরপর ব্রিয়ারলি স্মিথ ইস্ট লন্ডনে এসে দেখেশুনে নিশ্চিত করেন যে আসলেই মাছটি একটি প্রাচীন কোয়েলাক্যান্থ। এই আবিষ্কার প্রাণিবিজ্ঞানী মহলে আলোড়ন তোলে এবং ব্রিয়ারলি স্মিথ ওকোর্টেনে-ল্যাটিমার দুজনই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেন।
মজার ব্যাপার হলো পরের ১৫ বছরের মধ্যে এই প্রজাতির আর কোনো মাছের সন্ধান পাওয়া যায়নি। ১৯৫২ সালে মাদাগাস্কার এবং আফ্রিকার মূল ভূখণ্ডের মধ্যে অবস্থিত কোমোরো দ্বীপপুঞ্জের দুই জেলে দ্বিতীয় কোয়েলাক্যান্থটি খুঁজে পেয়েছিলেন।
১৯৯০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা আরেকটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার করেন, তারা ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জে কোয়েলাক্যান্থের দ্বিতীয় প্রজাতির সন্ধান পান। এখনও কোয়েলাক্যান্থের এই দুটি প্রজাতিরই দেখা মেলে: পশ্চিম ভারত মহাসাগর কোয়েলক্যান্থ (ল্যাটিমেরিয়া চালামনে), যা প্রাথমিকভাবে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে কোমোরো দ্বীপপুঞ্জের কাছে পাওয়া যায় এবং ইন্দোনেশিয়ান কোয়েলাক্যান্থ (ল্যাটিমেরিয়া মেনাডোয়েনসিস)।
প্রাচীন কোয়েলাক্যান্থ মাছ কীভাবে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছে, তার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো।
কোয়েলাক্যান্থগুলোর বেশ কয়েকটি অনন্য শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা লাখ লাখ বছর ধরে তাদের টিকিয়ে রাখতে সক্ষম করেছে। যেমন-তাদের লবড পেক্টোরাল পাখনা, যা স্থলজ মেরুদণ্ডী প্রাণীর অঙ্গসমূহের পূর্বসূরী বলে মনে করা হয়। পাখনাগুলো গভীর, জটিল ডুবো পরিবেশে চলাচলের জন্য দারুণভাবে অভিযোজিত।
কোয়েলাক্যান্থ গভীর ও স্থিতিশীল পরিবেশে বাস করে। যেমন- ডুবো গুহা এবং গভীর সমুদ্র। এসব স্থান ভূতাত্ত্বিক সময়ের সাথে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। এই পরিবেশগুলোতে কম শিকারী এবং কম প্রতিযোগী বাস করে, যা কোয়েলাক্যান্থকে কঠোর বিবর্তনীয় চাপ থেকে বাঁচতে সহায়তা করে।
কোয়েলাক্যান্থের বিপাকীয় হার তুলনামূলকভাবে কম, যা তাদের এমন পরিবেশে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে যেখানে খুব কম খাদ্য পাওয়া যায়। তাদের ধীর বিপাক দীর্ঘদিনের পরিবেশগত পরিবর্তন সহ্য করার ক্ষেত্রে অবদান রাখে।
তাদের পরিবেশগত কুলুঙ্গি (কুলুঙ্গি হলো পরিবেশগত কারণ এবং আন্তঃপ্রজাতির সম্পর্ক, যা প্রজাতিটিকে প্রভাবিত করে) সাধারণত গভীর, ঠান্ডা পানিতে দীর্ঘদিনেও খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। তাদের আবাসস্থলে এই স্থিতিশীলতার অর্থ তারা আরও পরিবর্তনশীল পরিবেশে বসবাসকারী প্রজাতির তুলনায় খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য কম চাপের মুখোমুখি হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে কোয়েলাক্যান্থের বিবর্তনীয় অভিযোজন, পরিবেশগত স্থিতিশীলতা এবং বিশেষায়িত পরিবেশগত কুলুঙ্গি প্রভৃতির সমন্বয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্যেও মাছটিকে পৃথিবীতে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে।
আপনার মতামত জানানঃ