জাহাজের ধাক্কায় তিমি মৃত্যুর ঘটনা প্রায়ই সামনে আসে, কারণ তিমির মরদেহ অনেক সময় ভেসে আসে সমুদ্রতটে। স্তন্যপায়ী প্রাণী তিমি কিন্তু মাছ নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় মাছ হলো হোয়েল শার্ক বা তিমি হাঙর (বৈজ্ঞানিক নাম: রিনকোডন টাইপাস)। দুর্ভাগ্যজনক হলো, নিতান্ত নিরীহ তিমি হাঙর আজ বিপন্ন। নৌযানের কারণেই বিলুপ্তির হুমকিতে আছে সুন্দর এই জলচর।
বিপুল সংখ্যায় তাঁরা জাহাজের ধাক্কায় মারা পড়ছে বিশ্বের মহাসমুদ্রগুলোতে। আর সেটি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যাচ্ছে।
কী পরিমাণ তিমি হাঙর এভাবে মারা পড়ছে তা জানতে হয়েছে একটি নতুন গবেষণা। যাতে সম্পৃক্ত হন আন্তর্জাতিক ৭৫ জন গবেষক। শিপিং বা জাহাজ শিল্প কীভাবে তিমি হাঙরদের মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে, সেখানে তুলে ধরেছেন তাঁরা।
ভারত, প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরসহ বিশ্বের উষ্ণ গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলের উষ্ণ জলরাশিতে বাস করে এই দৈত্যাকার প্রাণী। এপর্যন্ত পাওয়া সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্যের তিমি হাঙর ছিল ১৮.৮ মিটারের (৬১.৭ ফুট)। তবে গড় দৈর্ঘ্য ৩২ ফুট। এদের খাদ্য কিন্তু মাছ বা অন্য বড় প্রাণী নয়। বরং পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম জীবদের একটি বা প্ল্যাঙ্কটন।
সমুদ্রের যেসব অঞ্চলে তিমি হাঙরদের বিচরণ বেশি– সেগুলো মিলিয়ে একটি মানচিত্র তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা। তিমি হাঙরদের জনসংখ্যা ঘনত্বের এই জায়গাগুলো সমুদ্র জীববিজ্ঞানী মহলে ‘কনস্টেলেশন’ বা নক্ষত্রপুঞ্জ হিসেবেও পরিচিত। হোয়েল শার্কের পিঠে তারার মতো সাদা সাদা ফুটি থাকার জন্যই এমন নামকরণ।
২৬টি দেশের উপকূল ও সমুদ্রসীমায় কনস্টেলেশনগুলো চিহ্নিত করা হয়। এরপর ওই মানচিত্রের সাথে গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচের প্রদত্ত জাহাজ চলাচলের রুটগুলোর তথ্য মেলানো হয়। আমাদের সাগর-মহাসাগরগুলো কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, ব্যবস্থাপনায় কোথায় কোথায় ত্রুটি ও অসঙ্গতি রয়েছে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তা তুলে ধরে এই অলাভজনক সংস্থা। এজন্য গবেষকরা তাদের থেকে তথ্য নিয়েছেন।
নৌযানের ব্যাপক চলাচল আছে ইকুয়েডর, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ওমান, সিশেলস এবং তাইওয়ানের উপকূলের সমুদ্রে। যেখানে তিমি হাঙরের জনসংখ্যাও গুরুতর হুমকির সম্মুখীন। কী পরিমাণ তিমি হাঙর জাহাজের ধাক্কায় মারা যাচ্ছে, সেটি নিশ্চিত হতে না পারলেও – জাহাজ চলাচলের ব্যস্ত নৌরুটের কাছে তাঁদের আবাসস্থল হওয়ায় – সংখ্যাটি বেশ উচ্চ হবে বলেই ধারণা বিজ্ঞানীদের।
এ তথ্য জানান মেরিন রিসার্চ অ্যান্ড কনজার্ভেশন ফাউন্ডেশনের গবেষক ফ্রেয়া ওয়ার্মস্লে। তিনি আরও বলেন, “প্রথমবারের মতো তিমি হাঙরদের বৈশ্বিক জনসমষ্টি বা কনস্টেলেশনগুলোর মানচিত্র তৈরি করতে পেরেছি আমরা, এটি এই মাছেদের নিয়ে গবেষণাকারী সম্প্রদায়েরই অবদান।”
কিন্তু, জাহাজের ধাক্কায় কেন মারা পড়ছে তিমি হাঙররা। এর ব্যাখ্যায় বলা যায়, তিমির মতো স্তন্যপায়ী প্রাণীদের শ্বাস নেওয়ার জন্য পানির উপরে আসতে হয়, আর তখন জাহাজের ধাক্কায় তাঁদের প্রাণ হারানোর ঝুঁকি থাকে। শ্বাস নেওয়ার জন্য পানির উপরে আসতে হয় না হোয়েল শার্কদের, কিন্তু প্ল্যাঙ্কটন খেতে তারা অর্ধেকটা সময় কাটায় উপরের স্তরের কাছাকাছি।
ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির হাঙরের-বাস্তুসংস্থানবিদ মাইকেল হেইথাস বলেন, “উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ওই অংশে (পানির উপরিভাগে) তিমি হাঙরদের কতোটা সময় থাকতে হয় সেটি এই গবেষণায় উঠে এসেছে। এজন্য বিশ্বের বিভিন্ন সাগরে তিমি হাঙরদের (জিপিএস) ট্যাগিংয়ের তথ্য ব্যবহার করা হয়।
গবেষণাটি গত মে মাসে বৈজ্ঞানিক জার্নাল– সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রোমেন্ট’ এ প্রকাশিত হয়েছে।
এতে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, পৃথিবীর সাগর-মহাসাগরে জাহাজ চলাচল যেভাবে বাড়ছে, তাতে এই হাঙরদের রক্ষা করাটা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। বর্তমানে এক লাখের বেশি পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করছে সাগরে, ২০৫০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১,২০০ গুণ বাড়তে পারে।
শিপিং বা জাহাজে পণ্যবহন বহু শতরের এক শিল্প। তবে গত দুই শতক ধরে দৈত্যাকৃতির হয়ে উঠেছে এসব জাহাজ। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, বড় জাহাজগুলো এত দীর্ঘ সময় ধরে চলাচল করলেও তিমি হাঙরদের জাহাজের ধাক্কায় মৃত্যুর ঘটনা কেন এতদিন ধরে নজরে আসেনি। এর প্রধান কারণই হচ্ছে, চাক্ষুষ প্রমাণের অভাব।
ফ্রেয়া ওয়ার্মস্লে বলেন, “জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীর (তিমির) মরদেহ তীরে ভেসে আসে, ফলে সহজেই তা মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু হাঙররা মারা গেলে সাগরে তলিয়ে যায় তাদের মরদেহ।”
তিমি হাঙরদের কতোটা ক্ষতি করছে বড় জাহাজের চলাচল সে সম্পর্কে আগে খুব কমই জানা ছিল।
ছোট নৌযানের সাথে সংঘর্ষ হলেও অনেক সময় গভীর ক্ষত নিয়ে বেঁচে যেতে পারে হোয়েল শার্ক। এমন আঘাতের চিহ্নওয়ালা হাঙরদের দেখেওছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু, বড় জাহাজের সাথে ধাক্কা লাগলে নিশ্চিত মৃত্যু।
মাইকেল হেইথাস বলেন, “তিমি হাঙররা বেশ বড়ই হয়, তাই আঘাতটি প্রাণঘাতি নাহলে, তারা প্রায়ই বেঁচে যায়। কিন্তু বড় জাহাজের সাথে যদি ধাক্কা লাগে, তাহলে বাঁচার সুযোগই থাকে না।”
জাহাজের ধাক্কায় মৃত্যুর ঘটনায় তিমি হাঙরের বৈশ্বিক জনসংখ্যায় কতোটা প্রভাব পড়ছে, বিজ্ঞানীরা এখন তা জানার চেষ্টা করছেন। একেক সাগর অঞ্চলে তাঁদের জনসংখ্যার কম-বেশি রয়েছে। যেমন মেক্সিকোর ইয়ুকাতান উপদ্বীপ সংলগ্ন সাগরে প্রতিবছর ৪০০ তিমি হাঙর একত্রিত হয়। আবার, মাদাগাস্কারের উপকুলের সাগরে প্রায় ৫০০ তিমি হাঙরকে দেখা গেছে।
ফ্রেয়া ওয়ার্মস্লে বলেন, ওদের সম্পর্কে জানা-অজানা সব তথ্যকে আমরা জোড়াতালি দিয়ে একটি সম্পূর্ণ ছবি দাঁড় করাতে চাই। যাতে খুব বেশি দেরী হয়ে যাওয়ার আগেই এই প্রজাতিটিকে রক্ষা করতে পারি।
তিমির জন্য জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের রক্ষায় প্রচলিত দুটি পদ্ধতি কার্যকরভাবে কাজ করে, এগুলো হলো – জাহাজের গতিবেগ কমানো এবং রুট পরিবর্তন। ওয়ার্মস্লে মনে করেন, এই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার, শিপিং শিল্প, বিজ্ঞানী ও অলাভজনক সংরক্ষণ সংস্থাগুলো তিমি হাঙরদের রক্ষায় একযোগে কাজ করতে পারে। অর্থাৎ, বিচরণ এলাকায় প্রানীগুলো যেন জাহাজের ধাক্কায় মারা না পড়ে– সেটি এভাবে নিশ্চিত করা যাবে।
আপনার মতামত জানানঃ