মানুষ গতি ভালবেসে পোষ মানায় বনের ঘোড়াকে। চাকা আবিষ্কারের পর পশুবাহিত শকট তার পথশ্রম কমালেও মেলেনি গতি, মেলেনি স্বাধীন যাত্রা। অতএব আবিষ্কার বাইসাইকেলের। চাকার গতি আর ভারসাম্যের মিশেলের এক চমকপ্রদ রসায়ন। গতির গানে মিশে গেল স্বাধীন উড়ানের সুর।
তবে মানবসভ্যতাকে সাইকেলের আবিষ্কারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল শিল্পবিপ্লবের সময়, অর্থাৎ ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত। তখন মেশিন হয়ে উঠেছে সভ্যতার চালিকাশক্তি, আবিষ্কারকরা নিচ্ছেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
ইতিহাসের এ রকমই এক দিন ১৮১৭ সালের ১২ জুন। জার্মানির ম্যানহেম শহরের এক গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় প্রচুর মানুষের ভিড়। তাঁরা দেখতে এসেছেন এক নতুন আবিষ্কার। এমন এক নতুন যান, যা ঘোড়া বা কোনও বাহক পশু ছাড়াই মানুষের হাতে চলবে। সত্যি? এমন হয় নাকি? দেখার জন্যই জনসমাগম।
এলেন আবিষ্কারক ব্যারন কার্ল ভন ড্রেস। তাঁর বাহনের সামনে ও পিছনে দু’টি চাকা এক সরলরেখায় একটি কাঠের কাঠামোয় যুক্ত। কাঠামোর সামনে ত্রিভুজাকৃতি এক হ্যান্ডেল। আছে বসার আসন, স্যাডেল। আবার সামনে একটি রজ্জু যা পিছনের চাকায় যুক্ত, যা যানটির ব্রেক হিসেবে কাজ করে। কোনও প্যাডেল নেই। দুই পা মাটিতে ব্যবহার করে ভারসাম্য রেখে চালাতে হবে।
ড্রেস যানটি চালালেন। ম্যানহেম থেকে সোয়েটজ়িংগার পর্যন্ত। আট-ন’মাইল দূরত্ব যাত্রা করলেন এক ঘণ্টারও কম সময়ে। হেঁটে যাতায়াতের চেয়ে এক-চতুর্থাংশ সময়ে। যাত্রা শুরু হল পৃথিবীর প্রথম বাইসাইকেলের, যা আধুনিক বাইসাইকেলের আদিতম রূপ।
ব্যারন কার্ল ভন ড্রেস-এর জন্ম দক্ষিণ জার্মানির বাদেন-এর এক অভিজাত পরিবারে। তিনি বনবিভাগে কাজ করতেন, কিন্তু মগ্ন থাকতেন আবিষ্কারে। তিনি আবিষ্কার বা নির্মাণ করেছিলেন পিয়ানো-সুরকে রেকর্ড করার পদ্ধতি, বর্ণমালা নির্ণয় করার বাইনারি অ্যালগোরিদম, টাইপরাইটার ইত্যাদি। সময়ের দাবিই তাঁকে প্ররোচনা দিয়েছিল বাহক-প্রাণী ছাড়াই যানবাহন তৈরি করার।
সেই সময় জার্মানিতে চলছিল প্রবল রাজনৈতিক টানাপড়েন ও অর্থনৈতিক সঙ্কট। গ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে জারি করা অর্থনৈতিক অবরোধের আইন রাশিয়া না মানলে ১৮১২ সালে নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করেন। রাশিয়ার কৌশলে পিছু হঠে নেপোলিয়নের সৈন্যরা। রাশিয়া থেকে পশ্চাদপসরণের সময় ক্ষুধার্ত সৈন্যরা জার্মানি হয়ে যাওয়ার সময় লুঠ করে নিচ্ছিল শস্যভান্ডার।
তা ছাড়াও ১৮১৫ সালে হয় মাউন্ট টাম্বোরা আগ্নেয়গিরির ভয়ঙ্কর অগ্ন্যুৎপাত। তার ছাইয়ের মেঘে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার পরিবেশ হল বিপর্যস্ত, নষ্ট হয়ে গেল ফসল। খাদ্যের অভাবে ঘোড়া বা গৃহপালিত জন্তুরা মরে যেতে লাগল বা ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য তাদের খেয়েও ফেলা হতে লাগল। এই পরিস্থিতিতেই কার্ল ভন ড্রেস আবিষ্কার করলেন প্রথম পশু-বাহকবিহীন যান— বাইসাইকেল। তাঁর নামে অনুসারে প্রথমে এর নাম হয় ‘ড্রাইসিন’। আরও পরে এর নাম হয় ‘ভেলোসিপেড’।
জার্মানিতে ড্রাইসিন-এর সফল প্রদর্শনীর পরে ড্রেস ভাবলেন বাণিজ্যিক ভাবনা। বাণিজ্যিক সাফল্যের জন্য ১৮১৮ সালের এপ্রিলে প্যারিসের লুক্সেমবার্গ গার্ডেনে আয়োজন করলেন এক দর্শনীয় প্রদর্শনীর। সুসজ্জিত অভিজাত পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের উপস্থিতিতে আয়োজনটি উৎসবের চেহারা নিয়েছিল।
প্রথম দিকে ড্রেস-এর আবিষ্কার সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। যেমন অনেকে পার্কে বেড়ানোর জন্য এটি ব্যবহার করতেন। পার্কের বাইরে তা ভাড়াতেও পাওয়া যেত। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই চাহিদা বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি।
প্রথমত, তখন বেশির ভাগ রাস্তাই ছিল এবড়ো-খেবড়ো। আর ফুটপাতে চালালে তা ফুটপাতচারীদের পক্ষে বিরক্তিকর হয়ে উঠত। দ্বিতীয়ত, প্রথম প্রদর্শনীর পর সংবাদমাধ্যম আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। ‘সন্ডার’স নিউজ়লেটার’-এর ২৫ সেপ্টেম্বর ১৮১৭-র সংখ্যায় এই আবিষ্কারের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্যারিসে বাণিজ্যিক প্রদর্শনীর পর জোটেনি সে রকম ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া। ‘লিভারপুল মার্কারি’ কাগজটি তার ২৪ এপ্রিল ১৮১৮ সংখ্যায় কিঞ্চিৎ আশাবাদ দেখালেও ‘জার্নাল দ্য প্যারিস’ এই যানটিকে বাচ্চাদের খেলনা-ঘোড়ার সঙ্গে তুলনা করে বিস্তর নিন্দেমন্দ করেছিল।
বাইসাইকেলের প্রথম আবিষ্কারক হয়েছিলেন উপহাস ও ব্যঙ্গের শিকারও। ইতিহাসবিদ ডেভিড হ্যারিলদি উপহাস করে বলেছিলেন, ‘মুচিরা এটির প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। কারণ জুতো ক্ষয় করে এটি মুচিদের ব্যবসার সুবিধে করে দেবে।’ আর এক ইতিহাসবিদ অ্যান্ড্রু রিচি ব্যঙ্গ করে এটির নাম দিয়েছিলেন ‘ভোলসিপেড্রানিয়াভাপোরিয়ানা’ (Volcipedraniavaporiana) এবং বলেছিলেন, ‘এটির পেটেন্ট নিতে হবে পনেরো দিনে চোদ্দো মাইল যায় বলে।’
এই আবিষ্কার ড্রেসকে ব্যবসায়িক সাফল্য দিতে পারেনি, কারণ সেই সময়ে ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট’ বা পেটেন্ট-এর আইনকানুন তেমন পাকাপোক্ত হয়নি। ড্রেস পেটেন্ট-এর চেষ্টা করলেও তাঁর যানকে নকল করা থেকে ঠেকাতে পারেননি। ফ্রান্সের জনৈক ডেভিস জনসন-সহ অনেকেই তাঁর যানটি অনুকরণ করে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। আক্ষেপের কথা, জীবদ্দশায় ড্রেস তাঁর আবিষ্কারের যথাযোগ্য স্বীকৃতি পাননি। শেষ জীবনে ‘যন্ত্র আবিষ্কারক’ নয়, তিনি চর্চিত হয়েছিলেন এক ‘ব্যর্থ পাগলাটে উদ্ভাবক’ হিসাবে।
ব্যক্তিজীবনে ড্রেস ছিলেন ভাগ্যবিড়ম্বিত। চোদ্দো বছর বয়সে মাতৃহারা হন। তখনকার রাজনৈতিক নির্যাতন এড়ানোর জন্য তাঁকে ব্রাজিলে পালাতে হয়েছিল। ত্যাগ করেছিলেন ‘ব্যারন’ খেতাব। ১৮২৭-এ ফিরে এসে দেখেন তাঁর পিতা চরম অসুস্থ, মৃগীরোগে আক্রান্ত। তাঁর আত্মজীবনীকার লেসিং-এর বর্ণনা অনুযায়ী, ১৮৩০ সালে পিতৃবিয়োগের পর অবিবাহিত ড্রেস সুরার নেশাকে আঁকড়ে ধরেন। জার্মান রেভোলিউশনের ব্যর্থতার ভোগান্তিও নেমে আসে তাঁর উপর। বোনের প্রভাবে মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচলেও তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। নিঃস্ব অবস্থায় ১৮৫১ সালের ১০ ডিসেম্বর মারা যান ড্রেস। তাঁর অবদানের স্বীকৃতি তো মেলেইনি, বরং তা মুছে ফেলারও চেষ্টা হয়।
কিন্ত মেঘ আড়াল করলেও সূর্য জেগে থাকে তার দীপ্তি নিয়ে। ঊনবিংশ শতকের শেষে বাইসাইকেল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠল। বাইসাইকেলের জনক ড্রেস-এর নামে ফলক স্থাপিত হল তাঁর কার্লশ্রুহে-র বাসস্থানে। ১৮৯১ সালে তাঁর সমাধি স্থানান্তরিত হল নতুন সমাধিস্থলে। সেখানে স্থাপিত হল তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ।
তাঁর আবিষ্কারের দ্বিশতবর্ষ পূর্তিতে ২০১৭ সালে তাঁর ছবিসহ একটি জার্মান ইউরো মুদ্রা প্রকাশিত হয়। তাঁর স্মরণে মুদ্রিত হয় একটি ডাকটিকিটও। বেঁচে থাকতে গভীর মনোকষ্টে প্রয়াত আবিষ্কারক এ সবের কোনও আভাসই পাননি।
আপনার মতামত জানানঃ