দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার পর থেকে দেশের ভেতরে বিরোধী শিবির থেকে রাজনৈতিক কোনো চাপ দেখছে না আওয়ামী লীগ। দলটির টানা চতুর্থ দফার সরকার অনেকটা স্বস্তিতেই ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই রাজনীতির বাইরে আজিজ আহমেদ ও বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ক্ষমতাসীনদের সেই স্বস্তি কিছুটা উদ্বেগে রূপ নিয়েছে।
কারণ, তাঁরা দুজনই সরকারের বিশেষ ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। দুটি বাহিনীর শীর্ষ পদে থাকার সময় তাঁদের দুজনের বিরুদ্ধেই ক্ষমতা ব্যবহার করে দুর্নীতি করার অভিযোগ উঠেছিল। সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তিনি তাঁর ভাইয়ের ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরিতে প্রভাব খাটিয়েছেন। আর সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের আয়বহির্ভূত বিপুল সম্পদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষ করে নির্বাচন হয়ে যাওয়ার সাড়ে চার মাস পর সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, এ ঘটনায় সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব নিয়ে ক্ষমতাসীনদের অনেকের মধ্যে নতুন করে সন্দেহ ও অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, আজিজ-বেনজীরের ঘটনা সরকারের ভাবমূর্তিতে আঘাত করেছে, যা সরকারকে অনেকটা বেকায়দায় ফেলেছে; আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়েছে।
বিশেষ করে নির্বাচন হয়ে যাওয়ার সাড়ে চার মাস পর সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, এ ঘটনায় সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব নিয়ে ক্ষমতাসীনদের অনেকের মধ্যে নতুন করে সন্দেহ ও অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। সাবেক এই সেনাপ্রধানের ওপর হঠাৎ করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং পরপরই পুলিশের সাবেক প্রধানের ওপর থেকে সরকারের সমর্থন তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
অথচ র্যাব ও বাহিনীটির সাতজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র যখন ২০২১ সালে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, সে সময় আওয়ামী লীগ ও সরকারকে যতটা সোচ্চার দেখা গেছে, আজিজের ব্যাপারে সেটা দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বেনজীরের ওপর সমর্থনের ছাতা কেন গুটিয়ে ফেলা হলো, সেটাও অনেক আওয়ামী লীগ নেতার পুরোপুরি বোধগম্য হচ্ছে না। সরকার যে দুর্নীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছে, আমেরিকার কাছে তার প্রমাণ দেওয়ার একটা প্রয়াস হতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করেন।
আওয়ামী লীগের জেলা এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ের ১১ জন নেতার সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁদের মধ্যে এই মনোভাব লক্ষ করা গেছে। তাঁরা বিশ্বাস করেন, জেনারেল আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি রাজনৈতিক এবং তাঁদের সিংহভাগই ধারণা করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকারের অবস্থান নিয়ে আমেরিকা এখনো অসন্তুষ্ট। এ ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ভালো সম্পর্কের বিষয়ও একটি কারণ হতে পারে।
দুর্নীতির অভিযোগে আজিজ আহমেদের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার মধ্যেই সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের বিষয় সামনে এসেছে। তবে তাঁর বিরুদ্ধে সরকার আগে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
সন্দেহ কেন?
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের একটা আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক রয়েছে। তবে এই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের পর্যায়ে যায়নি। বরং বিভিন্ন সময় সম্পর্কের টানাপোড়েন বেড়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং বাহিনীটির তৎকালীন প্রধান বেনজীর আহমেদসহ সাবেক ও বর্তমান সাতজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। সেই সরকার ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায় থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছিল। এরপরও যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময় মানবাধিকার ও সুশাসনের প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ দিয়েছে।
সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির বিধিনিষেধ সম্পর্কের তিক্ততা সৃষ্টি করেছিল। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেছেন, বিএনপিসহ কিছু দল নির্বাচন বর্জন করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি সরকারবিরোধীদের সেই আন্দোলনের পক্ষে যায়, এমন মূল্যায়ন ছিল তাঁদের দল ও সরকারের ভেতরে। তবে নির্বাচনের পর গত কয়েক মাসে আওয়ামী লীগের ভেতর একধরনের স্বস্তি জন্ম নিয়েছিল যে সরকারের সঙ্গে আমেরিকানদের একটি বোঝাপড়া হয়ে গেছে।
নির্বাচন হওয়ার চার মাস পর গত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সফরে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তিনি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠকে এই বার্তা দেন যে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে মনোযোগী যুক্তরাষ্ট্র। অতীতের তিক্ততা সরিয়ে রেখে নতুন করে সম্পর্ক জোরদার করতে চায় দেশটি।
কিন্তু ডোনাল্ড লু ফিরে যাওয়ার কয়েক দিন পরই সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এসেছে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন ভূমিকায় তাঁরা অবাক হয়েছেন। তাঁদের দল ও সরকারের অনেকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। সে জন্য এ বিষয়টিকে সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক বলে একজন মন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকারকে একধরনের চাপে রাখার অবস্থানের পরিবর্তন করেনি যুক্তরাষ্ট্র। এই আলোচনাও রয়েছে তাঁদের মধ্যে।
তবে দুর্নীতি দমন, মানবাধিকার ও সুশাসনের প্রশ্নে সরকারের পদক্ষেপ দেশের ভেতরে-বাইরে কতটা আস্থা পাবে, এ নিয়ে বিশ্লেষকদের অনেকের সন্দেহ রয়েছে।
সরকারের ইঙ্গিতেই বেনজীর ইস্যু
দুর্নীতির অভিযোগে আজিজ আহমেদের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার মধ্যেই সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের বিষয় সামনে এসেছে। তবে তাঁর বিরুদ্ধে সরকার আগে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এখন সক্রিয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর সরকার–ঘনিষ্ঠ লোকদের আরও কারও বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে-এমন একটা আশঙ্কাও তৈরি হয় ক্ষমতাসীনদের অনেকের মধ্যে। এ ছাড়া ডোনাল্ড লু ঢাকা সফরের সময় দুর্নীতি দমনের বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করার কথা বলেছেন।
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ‘কাজের সম্পর্ক’ আরও বাড়াতে চায়। এই প্রেক্ষাপটে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি এসেছে। এ ছাড়া সামগ্রিকভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের দিক থেকে কঠোর কিছু পদক্ষেপ দেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করার বিষয় রয়েছে বলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ওই নেতা জানান।
তবে দলটির অন্য একাধিক সূত্র বলছে, সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত হলেও বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এতটাই ব্যাপক যে তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এ ছাড়া সমালোচনার মুখে সরকারের দিক থেকে একটা দেখানোর বিষয় রয়েছে যে তারা ক্ষমতাধর বা প্রভাবশালীদেরও ছাড় দেয় না।
এর মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকে বিতর্কিতদের একটা বার্তা দেওয়া হচ্ছে বলেও প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন একজন মন্ত্রী। কিন্তু বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে যখন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তার আগেই তিনি দেশ ছেড়ে গেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো জবাব পাওয়া যাচ্ছে না ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে।
সরকার এখন ভাবমূর্তি নিয়ে যে নেতিবাচক পরিস্থিতিতে পড়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে তারা। একজন মন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সরকারের একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরার বিষয়ে তাঁরা অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। তাঁরা গুরুত্ব দিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি করার পাশাপাশি ভারত ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার বিষয়ে।
তবে দুর্নীতি দমন, মানবাধিকার ও সুশাসনের প্রশ্নে সরকারের পদক্ষেপ দেশের ভেতরে-বাইরে কতটা আস্থা পাবে, এ নিয়ে বিশ্লেষকদের অনেকের সন্দেহ রয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ