২০২২ সালে নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অবস্থায় ইরানি তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল।
এই আন্দোলনেই সক্রিয় ভূমিকায় ছিল ১৬ বছর বয়সী নিকা শাকারামি। ফাঁস হওয়া একটি গোপন নথির বরাতে বেরিয়ে এসেছে আন্দোলনের সময় নিখোঁজ হওয়া ওই কিশোরীকে যৌন নির্যাতন এবং হত্যা করেছিলেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।
এ বিষয়ে বিবিসির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ইরানের রাজধানী তেহরানের রাজপথে আন্দোলনরত অবস্থায় মাথার স্কার্ফ পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল কিশোরী নিকা শাকারামি।
দেশটির প্রধান নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে স্বৈরাচার শাসক আখ্যা দিয়ে তাঁর মৃত্যু দাবি করে সে স্লোগান দিয়েছিল। সেদিনই নিখোঁজ হয় নিকা।
ফাঁস হওয়া নথিপত্রে জানা গেছে, সেদিন আন্দোলনে সরব ভূমিকার পর থেকেই নিকাকে অনুসরণ করতে শুরু করেছিলেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।
নিকার পরিবার জানিয়েছে, ২০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর থেকেই নিকার কোনো হদিস ছিল না। এর আগে সে তার এক বন্ধুকে জানিয়েছিল যে পুলিশ তাকে অনুসরণ করছে। ৯ দিন পর একটি মর্গে তার মরদেহ খুঁজে পায় পরিবার। কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল, আত্মহত্যা করেছে নিকা। তবে এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন নিকার পরিবারের সদস্যরা।
এ বিষয়ে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডসের ফাঁস হওয়া ওই নথিটি ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই নথিতেই নিকা এবং তার ওপর নির্যাতকারীদের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল। নির্যাতনকারীরা ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
ফাঁস হওয়া নথিতে ভয়ংকর সব তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তারের পর নিকাকে নিয়ে কী কী ঘটেছে সবকিছুরই উল্লেখ আছে এতে। ‘টিম-টুয়েলভ’ নামে ইরানের একটি নিরাপত্তা ইউনিট ঘটনার দিন তীক্ষ্ণ নজর রাখছিল নিকার ওপর। আন্দোলনে সরব উপস্থিতি এবং বারবার ফোনে কথা বলার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে তারা ভেবেছিল, আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকায় আছে নিকা।
নজরদারির বিষয়টি টের পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে নিকাকে গ্রেপ্তার করে নিজেদের ব্যবহৃত একটি ভ্যানের মধ্যে টেনে তোলে ওই নিরাপত্তা ইউনিট। এই ভ্যানেই নির্মম নির্যাতনের শিকার হয় নিকা।
গোপনীয় ওই নথির তথ্য অনুযায়ী, ভ্যানের পেছনের অংশে হ্যান্ডকাফ পরিহিত নিকার সঙ্গে ছিলেন নিরাপত্তা ইউনিটের তিন সদস্য। তাঁদের মধ্যে একজন নিকাকে যৌন নির্যাতন করেন। এ সময় নিকা নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা শুরু করেছিল। সে ওই নির্যাতনকারীকে লাথি এবং চিৎকারের মাধ্যমে দমানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু নিকার প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে তাকে থামানোর জন্য ওই তিন সদস্য পুলিশের ব্যবহৃত ব্যাটন দিয়ে মারাত্মকভাবে পেটাতে শুরু করেন।
নথিতে নিকার ওপর নির্যাতনকারী নিরাপত্তা সদস্যদের নাম উল্লেখসহ তাঁদের স্বীকারোক্তির কথা বলা হয়েছে। ভ্যানের পেছনে নির্যাতনকারীরা হলেন আরশ কালহোর, সাদেঘ মনজাজি এবং বেহরুজ সাদেঘি। ঘটনার সময় চারজনের ওই দলটির প্রধান মোর্তজা জলিল ছিলেন ভ্যানের সামনের অংশে চালকের পাশের আসনে।
অভিযুক্তরা স্বীকার করেছেন, ঘটনার সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। নিকাকে থামাতে গিয়েই তার মৃত্যু হয়।
গত বছর নিকার মা জানিয়েছিলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে নিকার মাথায় মারাত্মক আঘাতের বিষয়টি উল্লেখ ছিল।
নিকার ঘটনা ফাঁস হওয়ার সূত্র ধরে ইরানে সরকারবিরোধী আন্দোলন নতুন মাত্রা পেতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।
আপনার মতামত জানানঃ