কল্লোল দাশ বনি : বিজেপির প্রতি বাংলাদেশের হিন্দুদের একটা বিশেষ টান লক্ষ্য করা যায়। অনেকে প্রকাশ্যে কিছু বলে না কিন্তু বিজেপির উত্থানে বাংলাদেশের মানুষ মনে মনে খুশিই হয়। তবে এই টানটা শুধু বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে রয়েছে এমন নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালিদের মধ্যেও বিজেপি প্রীতি বেশ বেড়েছে। একদা বামপন্থী হিন্দু বাঙালি এখন কালের পরিক্রমায় রামপন্থী হচ্ছেন, বেশ ভালোই বুঝা যাচ্ছে। পশ্চিম বঙ্গের মানুষের এই পরিবর্তন কেন হচ্ছে জানি না কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্টীর মধ্যে এই বিজেপি প্রীতির কারণ সহজেই অনুমেয়। দিনের পর দিন নিজ দেশে অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত হওয়া এই মানুষগুলো বিজেপির মধ্যে নিজের পরাজয়ের প্রতিশোধের সম্ভাবনা দেখে। হয়তো ভাবে বিজেপি ভারতে শক্তিশালী হলে তারা বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করবে, দেশের ভিতরে কিছুটা আক্রমণ কমবে। অনেকে হয়তো ধর্মীয় ভাবাবেগের জায়গা থেকে বিজেপির জয়ের সাথে নিজ ধর্মের জয়জয়কার দেখেন। কিন্তু বিজেপি কি আসলেই হিন্দু ধর্মের জয়পতাকাবাহী কোন দল? বিজেপি কি আদৌ হিন্দু ধর্মীয় ভাবাবেগ ধারণ করে? বিজেপি কি হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভালো/মন্দের তোয়াক্কা করে?
এই আলোচনায় যাওয়ার আগে একজন ভদ্রলোককে গুগলে সার্চ দিয়ে চিনে নিন। নাম তার ঠাকুর সঙ্গীত সিং সোম, ওরফে সঙ্গীত সোম। ইনি হচ্ছেন, ভারতের বিজেপি পার্টির টিকিটে নির্বাচিত একজন বিধানসভা সদস্য। তবে তার খ্যাতি বেশি ছড়িয়েছে উত্তর প্রদেশের স্মরণকালের সবচেয়ে বড় দাঙ্গা যেটা ২০১৩ সালে সংগঠিত হয়েছিলো সেটার নাটের গুরু হিসেবে। দাঙ্গায় মদদ দাতা হিসেবে তার বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়। গোহত্যার বিরুদ্ধেও তিনি সদা সোচ্চার। এমনকি ফ্রিজের মধ্যে গরুর মাংস রাখার দায়ে গণ পিটুনিতে নিহত আখলাকের পরিবারের বিরুদ্ধেও মামলা করার কথা তিনি বলেছিলে। এমনই গরু ভক্ত নিষ্ঠাবান হিন্দু নেতার আসল পরিচয় কি জানেন?
তিনি আদতে একজন গরুর মাংস রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী। নির্বাচনে লড়ার আগে পর্যন্ত তিনি ভারতের অন্যতম বৃহৎ দুটি মাংস ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান “আল-দুয়া” এবং আল-আনাম এর অংশীদার ছিলেন। আল-দুয়ার তিনজন পার্টনারের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। এটা আমার বক্তব্য না, ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা দ্যা হিন্দু এই রিপোর্ট করেছে। কি চমকে উঠলেন? দম নেন। চমকানো আরও বাকি আছে।
এবার top beef exporting countries 2020 লিখে গুগলে সার্চ দেন। দেখবেন সেখানে ভারতের নাম তিন নম্বরে রয়েছে। আমেরিকা, কানাডাকে পিছনে ফেলে গরুর মাংস রপ্তানিতে ভারত বিশ্বের তিনটি দেশের মধ্যে একটিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর এটা করেছে কোন সময়? যখন পর পর দুই টার্ম ধরে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে রয়েছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার সেই সময়েই ভারতে গরুর মাংস ব্যবসার এমন রমরমা উত্থান। আর এইসব গরুর মাংস রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগেরই মালিকানা হিন্দু ব্যবসায়ীদের হাতে। সামনে দেখানোর জন্য দুই/একজন মুসলিম পার্টনার তারা কোম্পানিতে রাখে কিন্তু সিংহভাগ শেয়ারের মালিক থাকে বিজেপি আশ্রিত হিন্দুরাই। এই কোম্পানিগুলো শুধু নিজেরাই ব্যবসা করে না, নির্বাচনের সময় বিজেপির ফান্ডে মোটা টাকা চাঁদাও দেয়। বিবিসির একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যায়, মহারাষ্ট্রের দুটি বড় মাংস রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিজেপিকে ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিন চেকে ২ কোটি টাকা দিয়েছিলো। এমন অনেক প্রতিষ্ঠানই বিজেপিকে সময়ে সময়ে চাঁদা দিয়ে নিজেদের গরুমারা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন, সাথে নেতাদেরও পকেট ভারি করছেন।
বিজেপি দল কি হিন্দুত্ববাদী? তারা কি হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষা করে? ওয়েল, তাহলে এই প্রশ্নও করতে হয়, হিন্দু বলতে কি আপনি ব্রাম্মণ এবং অভিজাত হিন্দুদের বুঝেন নাকি তাদের সাথে দলিত ও শুদ্রদেরও বুঝেন? যদি আপনার সংজ্ঞায় শুদ্র ও অব্রাম্মণরা হিন্দু সমাজে থাকে তাহলে বলতে হবে, বিজেপি মোটেও হিন্দুত্ববাদী নয়, তারা মূলত ব্রাম্মণ্যবাদী একটি দল। এইটা বুঝার জন্য আপনাকে অনেক বড় পন্ডিত হতে হবে না, শুধু দলিত নির্যাতনের খবর নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করেন তাহলে দেখবেন গত দশ বছরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে কি পরিমাণ দলিত নির্যাতন বেড়েছে। কি কারণে নির্যাতন? শুনলে অবাক হতে হয় ভালো জুতা-জামা-কাপড় পরার কারণে, ভালো গাড়িতে চড়ার কারণে, পায়ের উপর পা তুলে বসার কারণে, অভিজাতদের সাথে চেয়ারে বসে খাওয়ার কারণে, নিজের বোন, বউকে অভিজাত কারো শোবার ঘরে না পাঠানোর কারণে ব্রাহ্মণ অভিজাতরা একদল মানুষকে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলছে। ভাবা যায়? এটা আপনি কখনো ভাবতে পারেন যে এইসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ অজুহাতে কেউ কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলে? যে সমস্ত ঘটনায় মানুষ মারা যায় শুধু সেই সমস্ত ঘটনাই পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয় কিন্ত যেগুলো প্রকাশিত হয় না এমন ঘটনা কয়েকশ গুণ বেশি। খুব সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের হাতরাস জেলায় এক দলিত মেয়েকে চারজন উচ্চ বংশীয় কুলাঙ্গার ধর্ষণ করে হাত, পা, কোমর ভেঙে এমনকি তার জিহবাটাও ছিড়ে ফেলেছে। এত ঘৃণা এত ঘৃণা এরা পোষণ করে মানুষের প্রতি!!! আর সেইসব ঘৃণাজীবিদের রক্ষা করে চলেছে বিজেপি শাসিত হিন্দুত্ববাদী সরকার। এইসব ধান্দাবাজেরা শুধু মুসলমানদের বিরুদ্ধেই নয়, নিজ ধর্মের ভিন্ন জাতির প্রতিও চরম ঘৃণার চর্চা করে।
বিজেপি যে শুধু দলিত বিরোধী তা নয়, তারা বাঙালি বিরোধীও। বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি, বাঙালিয়ানা সবকিছুর প্রতিই তাদের রয়েছে সীমাহীন ঘৃণা। বাঙালি জাতির মাছ খাওয়ার অভ্যাসকে তারা উপহাস করে মছলি বাঙ্গাল বলে। যদিও এখন ভোটে জেতার জন্য নানা ধরণের তোষামোদি কথাবার্তা তারা বলছে কিন্তু ভোটে জিতে সরকার গঠন করার পরেই দেখবেন কিভাবে তারা বাঙালি কমিউনিটিকে কোনঠাসা করে। কিছুদিন আগে বাংলা ভাষার প্রাচীনত্ব নিয়ে চলা এক বিতর্কে বিজেপির মুখপাত্র তরুণজ্যোতি তিওয়ারি তো বলেই ফেললেন “বাংলা ভাষার কোন যোগ্যতা নেই, বাংলা কোন ভাষাই নয়।“ তবে বিজেপি বাঙালির সাথে সবচেয়ে বড় বেইমানিটা করেছে আসামে এনআরসি আইন কার্যকর করে। অনেক বাঙালি হিন্দু এনআরসি নিয়ে মনে মনে মুচকি হাসেন, তারা মনে করেন এনআরসি করা হয়েছে মুসলিমদের ভারত থেকে তাড়ানোর জন্য এটা বাঙ্গালি হিন্দুদের কোন ক্ষতি করবে না। কিন্তু এটা যে কত বড় ভুল চিন্তা তা বুঝা যায় আসামের এনআরসি আইনের আওতায় বিদেশি ঘোষণা করা ব্যক্তিদের ধর্ম পরিচয় জানতে পারলে। ঐ তালিকার ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে মাত্র ৬ লক্ষ হলেন মুসলমান, ৫ লক্ষ বাঙালি হিন্দু আর বাকি ৮ লক্ষ অন্যান্য প্রদেশের মানুষ। অর্থাৎ, যে বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠী বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের আগে, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কিংবা তার পরে ভিটেমাটি হারিয়ে কিংবা অপমূল্যে বেচে দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল আজ এত বছর পরে আসাম সরকার সেই বাঙ্গালিকেই বিদেশি বলে সাব্যস্ত করল। এটা যদি এস্টাব্লিশ হয়ে যায় তাহলে বাকি বাঙ্গালিদেরও ধীরে ধীরে কালো তালিকাভুক্ত করে সকল প্রকার নাগরিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করবে।
এছাড়াও ভারতের অধপতনোন্মুখ অর্থনৈতিক অবস্থা, তার ধনী-দরিদ্র বৈষম্য, তার বড় বড় কর্পোরেট হাউসগুলোর সীমাহীন দূর্নীতি ও লুটপাটের চিত্র দেখে এটা ভালোভাবেই বুঝে নেয়া যায় বিজেপি আসলে ভারতের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির মতই একটা ব্যবসায়িক দল। রাজনীতি তাদের ব্যবসা আর হিন্দুত্ব তাদের পণ্য।
আমার এই সাত খন্ড রামায়ন লেখার মূল কথা হল, বাংলাদেশের যে সমস্ত হিন্দু জনগোষ্ঠী বিজেপির মধ্যে নিজেদের ভবিষ্যৎ আশ্রয়ের আশা করেন কিংবা যে সমস্ত হিন্দু অধিকার কর্মীরা ধর্মীয় রাজনীতিতে হিন্দু সমাজের সুরক্ষা দেখতে পান তারা বড় রকমের বিভ্রান্তির মধ্যে আছেন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সে যেকোন ধর্মেরই হোক, মানুষকে বোকা বানানোর কারখানা ছাড়া আর কিছু নয়। তাই বিজেপি, শিবসেনা টাইপের এইসব টাউটদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজের দেশে দাবীভিত্তিক রাজনীতির দিকে মনোনিবেশ করুন। দলমত নির্বিশেষে নিজেদের সংগঠিত করুন, বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলির কোল থেকে এবার নামুন। এটা এখন প্রমাণিত বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত কোন রাজনৈতিক দলই এ দেশের হিন্দুদের আর গোণায় ধরে না। তাই নিজেদের দাবী-দাওয়া নিয়ে নিজেদের সংগঠিত করুন এবং বাংলাদেশের সরকার ও রাষ্ট্রের উপর প্রেশার ক্রিয়েট করুন। দুই কোটি মানুষ সংঘবদ্ধ অবস্থান নিলে যেকোন কিছুই করা সম্ভব। ভারত নয় বাংলাদেশই বর্তমান, বাংলাদেশেই ভবিষ্যৎ।
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ